চর্যাপদ আবিষ্কার ও তার গুরুত্ব
বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের আবিষ্কারের গুরুত্ব:
অপভ্রংশেরর জঠর থেকে প্রাচীন বাংলা ভাষা যখন মুক্তি পেয়েছে সেই সময় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বাংলা সাহিত্যের ঊষালগ্নে ২৪ জন কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনতত্ত্বের গান চর্যাপদ। বাংলা কাব্য সৃষ্টি প্রচেষ্টার যা প্রাচীনতম নিদর্শন। এই পুঁথিটি মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে পুঁথিটি আবিষ্কার করেন। চর্যাপদ, শহরপাদ ও কাহ্নপাদের দুটি দোহাকোষ একত্রে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে ১৯১৬ খ্রী: ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে প্রকাশ করেন। এতে মোট পঞ্চাশটি পদ ছিল; কিন্তু তিনটি পুরো এবং আর একটি পদের শেষাংশ পাওযা যায়নি। উক্ত পুঁথিতে মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ পাওয়া গেছে।
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের প্রামাণিক নিদর্শন চর্যাপদ। এর পূর্বে ইতিহাস লেখকেরা মনে করতেন ময়নামতীর গান, গোরক্ষবিজয়, শূন্যপুরাণ, ডাক ও খানার বচন, রূপকথা—এইগুলি প্রাচীনতম বাংলা সাহিত্যের দৃষ্টান্ত। কিন্তু বর্তমান কালের আবিষ্কারে এবং গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, উল্লিখিত গ্রন্থ বা কাহিনি প্রাচীন যুগের নয়, অনেক পরবর্তীকালের রচনা। চর্যাপদ যদি আবিষ্কার না হয়, তবে আমাদের ভুলকেই স্বীকার করে নিতেই হত। এখানেই এর গুরুত্ব।
শুধু তাই নয়, প্রাচীনকালের সমাজ দর্শন আমাদের দৃষ্টির অগোচরে পড়ে থাকত অনন্তকাল। এখানে যে সমাজচিত্র পাই তা হল, এ সমাজর মানুষ পুরোপুরি কুসংস্কারাচ্ছন্ন নয়। অনেকটাই সংস্কার মুক্ত। চর্যাপদে মানুষের কথা নেই, সমাজের কথাও নেই, মানুষ সম্পর্কিত যেসব কথা আছে তাও আছে কেবল প্রতীকার্থে, বাস্তবার্থে নয়। তবুও সমাজের ছবিগুলির যে ইঙ্গিত রয়েছে, তা বিচিত্র সুন্দর। এর চতুর্দিকেই যেন দৃশ্যভুবন ভর করেছে। এখানে যেমন প্রকাশ পেয়েছে চর্যাকারদের বেদধর্ম বিরোধী মোহভাব—
“জাহের বাণচিহ্নরূপ ন জানী।
সো কইসে আগম বেত্রঁ বখানী।।”
তেমনি দেখা গেছে যৌন যৌগিক চিন্তাধারা, তান্ত্রিক কাপালিকদের কথা—
“নিঘিন কাহ্ন কাপালি জোই লাঙ্গ।”
কোথাও আছে শবরী নারীর বর্ণনা—
“উঁচা উঁচা পার্বত তাহিঁবসৈ শবরী বালী।”
কোথাও দেখা গেছে হরিণ শিকারের দৃশ্য, বীণা-নির্মাণের চিত্র। আবার জাতিভেদ-সংস্কার বর্জিত হয়ে কাপালিকদের যোগসঙ্গিনী হাওয়া। ডোম্বী ও পাটনী নারীর নদী পারাপার করার বৃত্তিগত পরিচয়, কর্মী মানুষের পেশাগত পরিচয়ের বৈচিত্র্য এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে। গৃহজীবনের দৃশ্যও আশ্চর্য সুন্দর—
“সুসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগঅ।
কানটে চোরে নিল কা গই মাগঅ।।”
চুরি, ডাকাতি ও নিরাপত্তার অভাবও সেই যুগেও ছিল। সামাজিক জীবনের অপরিহার্য পরিচয় রূপে প্রবাদ-প্রবচনের দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। যেমন,
“সুন গোহলী কিম দুঠ বলন্দে।”
(অর্থাৎ ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল)
—চর্যাপদের আবিষ্কারের গুরুত্ব এখানেই, যদি আবিষ্কার না হত তবে তৎকালীন মানুষের চিন্তা, ধ্যান-ধারণা থকে যে আমাদের দ্রুত সভ্য সমাজের চাল-চলন, রীতি-নীতির প্রসার ঘটছে, তা হত না।
পৃথিবীর সব দেশে কাব্যের প্রাথমিক আত্মস্ফূরণ প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে ধর্মচেতনা। কিন্তু তা কেবল ধর্মের গণ্ডীতেই আবদ্ধ হয়ে থাকেনি, সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে উঠেছে। চর্যাপদও যেন ধর্মের জয়তিলক ললাটে এঁকে সাহিত্যের আসরে প্রবেশ করেছে। তত্ত্বের ধূসর ঊষর মরুভূমিতে চর্যার কবি প্রবাহিত করেছেন ‘সকল রসের ধারা’। চর্যাগীতিতে যে ধর্ম সাধনার ইঙ্গিত আছে তা প্রধানত সহজযান বৌদ্ধ ধর্মের। এই ধর্মসাধনার সাধ্য ও সহজ এবং সাধন পদ্ধতিও সহজ। যদি তাঁরা সহজিয়া সাধক। এই ধর্ম সাধনার আড়ালে সমাজ-দর্শন প্রভৃতিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। যেমন পদকর্তা চাটিলের ৫ নং পদে আছে—
“ভবনই গহন গম্ভীর বেগেঁ বাহী।
দু আন্তে চিখিল মাঝে ন থাহী।।”
অর্থাৎ এই সংসার প্রবাহ নদীর প্রবাহের মতোই গভীর-গম্ভীর মায়ামোহ রচনা করে প্রবাহিত হচ্ছে। তাই দু’পাশে রয়েছে অনাপেক্ষিক নিবৃত্তি এবং ঐকান্তিক প্রবৃত্তির পঙ্ককুণ্ড।
চর্যাগীতির কাব্যমূল্যও অপরিমেয়। যা তার উত্তর সাহিত্য যুগকে সাহিত্য রচনায় তরান্বিত করেছে। কাব্য সম্পর্কে যে অলংকারবাদ ও ধ্বনিবাদ-এর কথা বলা হয়েছে, তা চর্যাপদে উপস্থিত। ধ্বনিবাদে বাচ্য অপেক্ষা বাচ্যাতীতের প্রাধান্য যেমন স্বীকৃতি পেয়েছে, তেমনি চর্যায় এই বিশেষত্ব সর্বত্র। বিভিন্ন ছন্দে চর্যাগুলিও রচিত হয়েছে। যেমন ত্রিপদী, পাদাকুলক, পজ্ঝড়ি প্রভৃতি।
সব মিলিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, চর্যাগীতির আবিষ্কার আমাদের সমাজ-ধর্ম-সাহিত্যকে এগিয়ে দেওয়ার রসদ যুগিয়েছে।