পূর্বরাগ, পূর্বরাগ পর্যায়ের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা, এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি ও তাঁর প্রতিভা
পূর্বরাগ:
মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী এক আশ্চর্য সাহিত্য সৃষ্টি। রূপ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য বৈষ্ণব পদাবলীকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছে। রাধা-কৃষ্ণের আধ্যাত্মিক বহু কাহিনি অবলম্বন কর পদগুলি বহু কবির সাধন ও মননের এক সার্থক সম্মিলিত রূপ। তবে বৈষ্ণব সাধক কবিরা ধর্মকথার রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে মানবীয় জীবন রসের আঁধারে পরিবেশন করেছেন। কৃষ্ণের প্রতি রাধার ঐকান্তিক আকর্ষণে তার পূর্বরাগ, মান, আক্ষেপানুরাগ, অভিসার, বিরহ ইত্যাদি পর্যায়ে ক্রমে ক্রমে ব্যক্ত করেছেন। পূর্বরাগ হল বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে তথা বৈষ্ণব পদাবলীর প্রথম স্তর বা পর্যায়।
পূর্বরাগের সংজ্ঞা:
পূর্বরাগ শব্দের অর্থ প্রথম অনুরাগ অর্থাৎ প্রেমের ‘প্রথম জাগরণ’। বৈষ্ণব শাস্ত্রের আকরগ্রন্থ শ্রীরূপ গোস্বামীর ‘উজ্জ্বলনীলমনি’-ত পূর্বরাগের সংজ্ঞা এইভাবে দেওয়া হয়েছে—
“রতির্যা সঙ্গমাৎ পূর্বং দর্শন-শ্রবণাদিজা।
তয়োরুন্মীল্যতে প্রাজ্ঞৈঃ পূর্বরাগঃ স উচ্যতে।।”
অর্থাৎ মিলনের পূর্বে পরস্পর দর্শন শ্রবণ প্রভৃতি থেকে উদ্ভূত নায়ক নায়িকার মিলন ইচ্ছার যে রতি বা প্রীতি তাকেই বলে পূর্ব রাগ।
পূর্বরাগের স্বরূপ:
পূর্বরাগ প্রত্যক্ষ দর্শন, চিত্র দর্শন, স্বপ্নে দর্শন, মুরারি শ্রবণে, নাম শ্রবণে প্রভৃতি নানা ভাবে ঘটতে পারে। বৈষ্ণব কবিরা তাদের রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাই এই প্রথম পর্যায়টি বর্ণনা করতে গিয়ে মূলত শ্রীরাধিকার-ই পূর্বরাগ দেখিয়েছেন। অবশ্য শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগেরও কিছু কিছু পদ পাওয়া যায়। এই পদে নায়ক-নায়িকার প্রেমের নানা লক্ষণ সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে অলংকার শাস্ত্র অনুযায়ী। পূর্বরাগ বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গারের অন্তর্গত।
পূর্বরাগে বিরহের দশটি দশাও ঘটতে পার। এই দশটি দশা যথাক্রমে—লালসা, উদ্বেগ, জাগর্যা, তানব, জড়তা, ব্যগ্রতা, ব্যাধি, উন্মাদ, মোহ ও মৃত্যু।
পূর্বরাগের শ্রেণিবিভাগ:
বৈষ্ণব পদাবলীতে দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণের রূপানুরাগের কথা শুনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রী রাধিকা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে শ্রী রাধিকার কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ পূর্বরাগে অনুরঞ্জিত হয়েছে। পূর্বরাগ তিন প্রকারের—‘সাধারণী’, ‘সমঞ্জসা’ ও ‘সমর্থা’। বৈষ্ণব পদাবলীতে ‘সমর্থা’ পূর্বরাগই বর্ণিত হয়েছে। কৃষ্ণের প্রতি ইচ্ছাপূরণের জন্য লোকনিন্দা, ধর্মভয় প্রভৃতি অবজ্ঞা করে শ্রীকৃষ্ণের জন্য ব্যাকুল হলে ‘সমর্থা’ পূর্বরাগ হয়; শ্রীরাধিকার ছিল এই পূর্বরাগ।
পূর্বরাগ পর্যায়ের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা
বৈষ্ণব পদাবলীর সৃষ্টির বহু পূর্ব থেকে সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় লৌকিক প্রেমকে আশ্রয় করে পূর্বরাগের অনেক পদ রচিত হয়েছে। সেগুলির সঙ্গে এইসব পদের মৌলিক কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে চৈতন্য পূর্বযুগে বাংলা ও ব্রজবুলির পদগুলিতে আদি রসের সঙ্গে ভক্তি রসের কিঞ্চিত মিশ্রণ ঘটেছে। আর চৈতন্য পরবর্তীকালে বৈষ্ণব কবিতায় এসেছে ‘কামগন্ধহীন’ প্রেমের আর্তি। গীতাতে স্বয়ং ভগবান বলেছিলেন তাকে পাওয়ার পথ হল—“ সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।” চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব কবিতায় এবং চণ্ডীদাসের পদে এভাবে ভগবানকে পাওয়ার প্রচেষ্টা রয়েছে। পূর্বরাগ সেই প্রচেষ্টারই প্রথম ভাগ, প্রথম প্রস্তুতি। পূর্বরাগের পদে শ্রীরাধার অন্তরে যে ব্যাকুলতা প্রকাশিত হয়েছে তা দেহধর্মের প্রয়োজনে নয়, তা প্রকৃতপক্ষে ভগবানের জন্য একাত্ম হওয়ার জন্য। রাধা ভক্তকুলের প্রতিভূ মাত্র। ভক্ত কীভাবে ভগবানকে পেতে পারে তার আদর্শই যেন তার সাধনার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত। তবে সুগন্ধি লাভের জন্য যেমন ধূপকে পোড়াত হয় তেমনিভাবে আধ্যাত্মিকতা প্রকাশে বৈষ্ণব কবিগণ দেহকে অবলম্বন করেছে।
পূর্বরাগ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি ও তাঁর প্রতিভা:
বৈষ্ণব পদাবলীতে শ্রীরাধার পূর্বরাগকে কেন্দ্র করে বহু কবি পদ রচনা করেছেন। এই পর্যায়ের পদে বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস প্রমুখ কবি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। কিন্তু চণ্ডীদাসই শ্রেষ্ঠ। তিনি তার পূর্বরাগের পদগুলিতে মানবিক ও লৌকিক ব্যাকুলতাকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনায় পরিণতি দান করেছেন। আবেদনে, সৌন্দর্যে তাঁর পূর্বরাগের পদগুলি বৈষ্ণব কবিতার রত্নভাণ্ডারে এক-একটি উজ্জ্বল মহামূল্যবান রত্ন যা প্রেমিকের হৃদয় সাগরে ডুব দিয়ে সংগৃহীত। তাঁর কয়েকটি পদ আলোচনা করলে এই কথার প্রমাণ পাওয়া যায়।
চণ্ডীদাসের পূর্বরাগের একটি পদে শ্যাম নাম শোনা মাত্রই রাধার হৃদয়ে প্রেমাস্পদের জন্য আকুলতা ও আবেগ জেগে উঠেছে। তার শ্রুতি পথ ধরে শ্যাম নাম তার মর্মলোকে প্রবেশ করেছে। আর সে হয়ে উঠেছে প্রেম উন্মাদিনী। তখন সখিকে সম্বোধন করে তার অস্থিরতার কথা জানিয়েছে—
“সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।।”
শ্যাম নাম কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্র রাধার দেহ কোষে কোষে জেগেছিল চাঞ্চল্য। তারপর থেকে এই নামই হয়ে উঠেছিল তার জপমন্ত্র। এই নাম জপ করতে করতে তার শরীরে আবেশ জেগেছিল। সেই মধুর নামের অধিকারী ব্যক্তিটিকে আপন অঙ্গনে পাওয়ার প্রবল আর্তি নিয়ে সে সখিকে জিজ্ঞাসা করেন—“কেমনে পাইব সই তারে।”
শ্যাম নাম তার জীবনে সর্বস্ব হয়ে ওঠার পর তার মনে হয় এই নামেরই যখন এত প্রতাপ, এত যাদু তখন—শ্যাম দেহের প্রভাব না জানি কেমন। তিনি মনে মনে ভাবেন—শ্যাম যদি তাকে স্পর্শ করেন তখন শ্যামচন্দ্রের অপূর্ব দেহ লাবণ্য ও রূপ মাধুরী তাকে এমন মাতিয়ে তুলবে যে তার পক্ষে আর যুবতি ধর্ম রক্ষা করা সম্ভব হবে না। একজন নারীর পূর্বরাগের মনস্তাত্ত্বিক রূপায়নের সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিকতা উপলব্ধির গভীরতায় চণ্ডীদাসের এই পদ রসোত্তীর্ণ তো বটেই আশ্চর্য সুন্দর হীরক দীপ্তিও লাভ করেছে।
আর একটি পদে দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাধার নব পরিচয় হওয়ায় তিনি পূর্বরাগাক্রান্ত হয়েছে। জগত সংসার তার চেতনায় তুচ্ছ হয়ে গেছে। কেবল সে খানিকের সেই পুরুষের ভাবনাতেই মগ্ন। তার জন্য সে সাধনায় নেমে যোগিনীর মত রাঙা বসন পরেছে। আহারের কথা একেবারে ভুলে গেছে—“বিরতি আহারে—রাঙ্গা বাস পরে, যেমন যোগিনী পারা।”
শ্রীকৃষ্ণের একাগ্র হয়ে রাধা কেবল একাকিনী বসে থাকে। এই প্রেম ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তার কর্ণকুহরে কারও কোন কথাই আর প্রবেশ করে না। শ্যামবর্ণের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকায় মেঘের দিকে চেয়ে থাকে অনিমেষ নয়নে, মাথার চুল খসিয়ে তার কৃষ্ণরূপ দেখে। হাসিমুখে মেঘের দিকে চেয়ে কৃষ্ণভ্রমে দুহাত তুলে কত কথায় না বলে! কৃষ্ণ রূপের সঙ্গে সাদৃশ্যকে ময়ূর ময়ূরী কণ্ঠকেও নিরীক্ষণ করে। রাধার এই ভাবান্তর কারও কারও কাছে যাতে অস্বাভাবিক মনে না হয় সেজন্য কবি চণ্ডীদাস তার কারণও উল্লেখ করে দিয়েছেন—“নব পরিচয়, কালিয়া বঁধুর সনে।” এই পূর্বরাগের পদটিতে রাধার যে অন্তরের বেদনা প্রেম সাগরের অতল তলে নিমগ্ন, প্রেমময়ী যে মূর্তি ধরা পড়েছে তা অতুলনীয়।
পূর্বরাগের এই সমস্ত পদে রাধার অপরূপ প্রেম ও উন্মাদিনী মূর্তি আমরা দেখতে পায়। তার হৃদয়ে যে মর্মভেদী ব্যাকুলতা শুনতে পায় তা চণ্ডীদাসের মতো কবির পক্ষেই প্রকাশ করা সম্ভব। কবি এখানে রাধার দেহ কিংবা মনোলীলা বিলাসের চিত্র ফুটিয়ে তোলার অবকাশ সৃষ্টি করেননি। তাঁর রাধিকা যেন ধ্যান গম্ভীর স্বর্ণ প্রতিমা। তিনিও প্রতি মুহূর্তেই কৃষ্ণের কারণে প্রেমরসে সিক্ত। তার যৌবনে যোগিনী মূর্তি এই পদগুলিকে এক অপরূপ শোভা ও চিরন্তনত্ব দান করেছেন। প্রকৃত পক্ষে এই পর্যায়ের পদে চণ্ডীদাসের শ্রেষ্ঠত্ব সবদিক দিয়েই অবিসংবাদিত। তিনি ভাবের দিক থেকে যেমন সহজ অথচ গভীর তেমনই ভাষার ক্ষেত্রেও। তবে পূর্বরাগের পদ রচনায় তার শ্রেষ্ঠত্বের মুখ্য কারণ তিনি স্বয়ং রাধাকৃষ্ণের বিরহ জনিত বেদনাকে হৃদয়ান্তরে অনুভব করতে পেরেছিলেন। রাধার বেদনার সঙ্গে কবির বেদনার স্তর এক পর্যায়ের হওয়াতে পূর্বরাগের পদগুলি যেমন শিল্প সুষমায় মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে তেমনই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাহিত্য রসপিপাসু ভক্ত সাধক সমস্ত বাঙালিকে বিরহ বাঁশীর ব্যাকুল প্রেমক্রন্দন শুনিয়েছেন।