অভিসারের সাধারণ পরিচয়, অভিসার পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি ও তাঁর কবি কৃতিত্ব:
অভিসার:
বৈষ্ণব কবি সাধকগণ প্রেমলীলা বৈচিত্র্য অবলম্বনে অসংখ্য পদ রচনা করেছেন। যাদের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে রাধাকৃষ্ণের প্রেম, মিলন, বিরহ প্রভৃতি বিষয়। কীর্তনের পালা গানের সুবিধার জন্য গায়কেরা রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে নানা ভাবে ভাগ করে নিয়েছেন। এই ভাগগুলিকে বলা হয় পর্যায়। এই পর্যায় গুলি হল—পূর্বরাগ, অভিসার, মিলন, মান, বিরহ, মাথুর, ভাবসম্মেলন, আক্ষেপানুরাগ, নিবেদন, পার্থনা প্রভৃতি। এদের মধ্যে অন্যতম বিভাগ হল অভিসার।
অভিসারের সংজ্ঞা ও শ্রেণি বিভাগ:
নায়ক বা নায়িকার প্রিয় মিলনের উদ্দেশ্যে সংকেত স্থান গমনকে অভিসার বলা হয়। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে ত্রয়োদশ প্রকার নায়ক নায়িকার কথা বলা হয়েছে। এদের প্রত্যেকের আটটি অবস্থা তার প্রথমটি হল অভিসারিকা। ‘উজ্জ্বলনীমণি’-তে রূপগোস্বামী অভিসারিকার লক্ষণ সম্বন্ধে বলেছেন—
“যাভিসারয়তে কান্তং স্বয়ং বাভিসরত্যপি।
সা জ্যোৎস্নী তামসী যানযোগ্যবেষাভিসারিকা।।
লজ্জয়া স্বাঙ্গলীনেব নিঃশব্দাখিলমণ্ডনা।
কৃতাবগুণ্ঠা স্নিগ্ধৈকসখীযুক্তা প্রিয়ং ব্রজেৎ”
অর্থাৎ যে নায়িকা কান্তাকে অভিসার করান অথবা স্বয়ং অভিসার করেন তাকে বলা হয় অভিসারিকা। এই অভিসারিকা জ্যোৎস্না ও অন্ধকারে গমনযোগ্যা। জ্যোৎস্নী এবং তামসী ভেদে দুই প্রকার। কান্তসমিপে অভিসার কালে এই নায়িকা যেন লজ্জায় স্বীয় অঙ্গে লীন হয়ে থাকেন, এর কঙ্কণ ও নুপূরাদি ভূষণ যাকে শব্দহীন, অবগুণ্ঠনবতী হয়ে সে একজন মাত্র সখির সঙ্গে গমন করেন।
বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে আট প্রকার অভিসারের বর্ণনা আছে—জ্যোৎস্নাভিসার, তমসাভিসার, বর্ষাভিসার, দিবাভিসার, কুজ্ঝটিকাভিসার, তীর্থযাত্রাভিসার, উন্মতাভিসার, সঞ্চারাভিসার। ‘উজ্জ্বলনীলমণি’র সংজ্ঞা অনুসারে নায়কেরও অভিসার রয়েছে। পদাবলীতে কৃষ্ণের অভিসার রয়েছে। তেমনি ইউরোপীয় সাহিত্য ‘Serenade’ প্রেমের অমোঘ আকর্ষণে এই যে কষ্ট স্বীকার করেও প্রেমাস্পদের জন্য অভিসার—তা প্রাচীন ঐতিহ্যানুময়। কুমারসম্ভবের উমা, কাদম্বরীর মহাশ্বেতা সব বাধা তুচ্ছ করে দয়িতের উদ্দেশ্যে অভিসারে গমন করেছিল। তবে দেখা যায় পদাবলীর বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের অভিসারের বীজ নিহিত ছিল—‘শ্রীমদ্ভাগবত’-এর ‘রাসপঞ্চাধ্যায়ে’ অথবা জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্’-এ।
অভিসার পর্যায়ের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা:
অভিসারের যেমন একটি লৌকিক দিক রয়েছে তেমনি আছে আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে। পূর্বরাগের প্রেমাকর্ষণের পর নায়ক-নায়িকার মন স্বভাবতই মিলনের জন্য উন্মুখ হয়। আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতি, নানা বিধি-নিষেধের পরিচিত পরিবেশে মিলনের কোন সুযোগ নেই—সম্ভাবনাও কম। তাই প্রয়োজনে নিভৃত, নির্জন একটি কুঞ্জ যেখানে নীলনির্জনতায় দুটি প্রাণ নিবিড় মিলনে একপ্রাণ হয়ে যেতে পারে। মিল প্রতীক্ষায় অধির দহিতের কাছে সমস্ত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে প্রেমের পরীক্ষা দিতে দয়িতা পৌঁছায় কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। যাওয়ার পথ হোক না কণ্টকাকীর্ণ, পিছল, অন্ধকারময় তা পেরিয়েই তো চরমতৃপ্তি, চরম আনন্দ। রোমান্টি আবেশের মধ্যে রয়েছে অলৌকিক জগতের অভিসার—আত্মার অভিসার, ভূমার প্রতি অভিসার, পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার অভিসার। তাই আধুনিক কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়—
“তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা-বজ্রপাতে,”
বৈষ্ণব কবিরা এই অভিসারের আকুলতা বজায় রেখেও তাকে নিয়ে গেছেন সেই অলৌকিকতার আনন্দলোকে। লৌকিক অভিসারের ইন্দ্রিয় চেতনাকে তারা পৌঁছে দিয়েছেন অতীন্দ্রিয় চেতনায়। অভিসারের প্রকৃত অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষ্ণলাভের প্রতীকী ব্যঞ্জনা।
লৌকিক অভিসারের দুঃখ-কষ্ট জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করার একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
কিন্তু অভিসার যেখানে ভাব বন্যায় ভাগবত মুখী সেখানে কৃচ্ছ্রসাধনার কোন সীমাবদ্ধতা
নেই। ভাগবত মিলনের জন্য ভক্ত তখন প্রাণ বিসর্জনে প্রস্তুত।
অভিসার পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি ও তাঁর কবি কৃতিত্ব:
গোবিন্দদাস অভিসার পর্যায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। অভিসারের পদে যত বৈচিত্র্য রয়েছে তার প্রায় সবই গোবিন্দদাস রূপাঙ্কিত করেছেন রাধার অভিসারের মধ্যদিয়ে স্বকীয় দক্ষতায়। অনুপম বর্ণনা, অনবদ্ধ চিত্র ধর্মীয়তা, নাটকীয়তা, সঙ্গীত হিল্লোল, সুনিবিড় উপলব্ধি ও সর্বোপরি শিল্পসুষমা মণ্ডিত কবি দৃষ্টি গোবিন্দদাসের পদগুলিকে অপরূপ রস দান করেছে—
“কণ্টক গাড়ি কমলসম পদতল
মঞ্জির চীরহি ঝাপি।
গাগরি-বারি ঢরি করু পিছল
চলতহি অঙ্গুলি চাপি।।”
পদটিতে রাধার কৃচ্ছ্রসাধনার অভ্যাস ও পুনঃ পুনঃ অভ্যাস এবং প্রস্তুতি রয়েছে। এটি বর্ষাভিসারের পদ। রাধা কৃষ্ণাভিসারে যাওয়ার জন্য আঙিনায় কাঁটা পুঁতে তার উপর দিয়ে হেঁটে চলার অভ্যাস করছে। অন্ধকারে রাত্রিতে পথ চলতে গেলে কাঁটা ফুটতে পারে, পথ পিছল হতে পারে, পায়ের নূপুর বেজে উঠতে পারে তাই ঘরেই রাধা সাধনা করছেন এসব যাতে না হয়। সে উঠানে জল ঢেলে কাঁটা পুতে পা’য়ের নূপুরে কাপড় বেঁধে পথ চলার অভ্যাস করছে। আবার বর্ষাভিসারে পথের শত্রু সাপকে বস করার জন্য করকঙ্কণ বাঁধা রেখে সাপের ওঝার কাছে মন্ত্র শিখে নেয়।
“কর-কঙ্কণ-পণ ফণিমুখ-বন্ধন
শিখই ভূজগ-গুরু পাশে।।”
ভগবানের কাছে ভক্ত পৌঁছাতে গেলে তাকে তো কষ্ট করতে হবে। সুখের মধ্য দিয়ে কি ভগবানকে পাওয়া যায়। তাই—
‘‘মাধব তুয়া অভিসারক লাগি।
দূতর পন্থ গমন ধনি সাধয়ে
মন্দিরে যামিনি জাগি।।’’
যাইহোক, গোবিন্দদাস দেখিয়েছে শ্রীমতী রাধার অভিসারে প্রকৃতি একমাত্র বাধা নয়, সমাজ-সংসার-সংস্কার সব-ই তো পথ আগলে দাঁড়িয়ে। গুরুজনের কথায় কর্ণপাত না করার পন্থা অবলম্বন করেন শ্রীরাধা—
“গুরুজন-বচন বধিরসম মনই
আন শুনই কহে আন।।”
রাধা বধিরতা অবলম্বন করেছে এবং পরিজন যা বলেন তা যেন শুনতে পায় না। শুধু বোকার মতো হাসেন। এই অবাধ্যতার অন্য তাৎপর্য আছে—কৃষ্ণ যার অন্তর জুড়ে আছে সে কি অন্য কথা শুনতে পায়।
তাই সবশেষে বলা যায় অভিসারের অপরূপ রসব্যঞ্জনায় গোবিন্দ দাস অসাধারণত্বের পরিচয় দিয়েছেন। প্রস্তুতি পর্বের মাধ্যমে রাধার অভিসারে বাস্তব রূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন। ভাষায় ভাবে এবং উপস্থাপনাতে তার প্রতিভাগুণ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখানেই গোবিন্দ দাসের কৃতিত্ব।