গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ ও গৌরচন্দ্রিকা পদের সাধারণ পরিচয়, উদ্দেশ্য, এই দুটি পর্যায়ের মধ্যে পার্থক্য
গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ ও গৌরচন্দ্রিকা পদের সাধারণ পরিচয়:
চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বাংলা দেশের বৈষ্ণব ধর্মের মহাপ্লাবন ঘটে ছিল। বৈষ্ণবরা মনে করতেন গৌরাঙ্গদেব ছিল ‘রাধাভাব দ্যুতি সুবলিত তনু’। এবং তার মহাজীবনকে নিয়ে বৈষ্ণব পদকর্তারা অসংখ্য পদ রচনা করতেন। পূর্বে বৈষ্ণব কবিরা কেবলমাত্র রাধা-কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে পদ রচনা করতেন। কিন্তু চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর তাদের রচনায় বৈচিত্র্য এল। এই যে চৈতন্য দেবকে কেন্দ্র করে যে অসংখ্য পদ রচিত হয় এগুলিকে বলা হয় গৌরাঙ্গ বিষয়কপদ। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে সামঞ্জস্য রেখে অনেক গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ রচনা করা হয়। যেগুলিকে গৌরচন্দ্রিকা বলা হয়। পালাবদ্ধ রস সংকীর্তনে যে বিশেষ রস পর্যায়ে পালাগান পরিবেশিত হয় তার প্রারম্ভে সেই সাদৃশ্য কোনো গৌরলীলার পদরীতিকে গৌরচন্দ্রিকা বলে। অর্থাৎ পালাকীর্তনে যে রসের অবতারণা করা হয় সেই রসেরই দ্যোতক ও ভাবানুকুল গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদটি পালার প্রারম্ভে গাওয়া হয়। তাই গৌরচন্দ্রিকা লীলাকীর্তনের ভূমিকা স্বরূপ তার অচ্ছেদ্য অঙ্গ গৌরচন্দ্রিকা কথাটির অর্থ হল—‘গৌরাঙ্গ রূপ চন্দ্রের স্নিগ্ধ কিরণ’। ‘গৌরচন্দ্র ইয়ম্’ অর্থাৎ গৌরাঙ্গলীলা এই অর্থে গৌরচন্দ্রিকা। অর্থাৎ গৌরাচন্দ্রিকার মধ্য দিয়ে বৃন্দাবনের রাধা আর নবদ্বীপের চৈতন্যের ভাব সাদৃশ্য পট হয়।
গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ ও গৌরচন্দ্রিকা পদের উদ্দেশ্য:
রাধাকৃষ্ণলীলা কীর্তনের পূর্বে গৌরচন্দ্রিকা পরিবেশনে তাৎপর্য অতিশয় গভীর। রাধাকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলায় সাধারণ ভাবে শ্রোতার কাছে মর্ত নরনারীর কামনা-বাসনা পূর্ণ প্রকৃত প্রেমলীলা বলে ভুল হতে পারে—এই আশঙ্কা বৈষ্ণব কবি ও গায়কদের ছিল। শ্রোতা যাতে এ ভুল না করে সেই জন্য পূর্বে শ্রোতাবৃন্দের মানসলোকে আধ্যাত্মিক ভাব প্রকাশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গৌরচন্দ্রিকা গাওয়া হয়। সাধারণ শ্রোতার কাছে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য রূপ অনাবিষ্কৃত থাকে। এই কারণে কীর্তনের ভূমিকা স্বরূপ চৈতন্যদেবের অলৌকিক জীবন লীলা কেন্দ্রিক গৌরচন্দ্রিকা পরিবেশন করে প্রথমে বিষয়টি বোধগম্য ও আধ্যাত্মিকতার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়।
গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ ও গৌরচন্দ্রিকা পদের পার্থক্য:
গৌরচন্দ্রিকা ও গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদগুলির মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বৈষ্ণব পদাবলী হল রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বিচিত্র রস সম্বলিত ভক্ত সাধক কবি রচিত গীতিকবিতা। অপর দিকে গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদগুলি একান্ত ভাবে চৈতন্যদেব বা গৌরাঙ্গদেবের জীবনী বিষয়ক গীতিকবিতা। বৈষ্ণব পদাবলী ও গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদগুলির মধ্যে সেতু বন্ধন রচনা করেছে গৌরচন্দ্রিকা। প্রতিটি গৌরচন্দ্রিকায় গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ কিন্তু গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ মাত্রই গৌরচন্দ্রিকা নয়—কেননা সব গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদের মধ্যে রাধাকৃষ্ণ লীলার ভাবানুকুল বিষয় প্রকাশিত হয় না। অনেক গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদে আছে শুধু গৌরাঙ্গ রূপের বর্ণনা। তাঁর বহিরঙ্গ জীবনের কাব্যিক বর্ণনা দিয়ে মণ্ডিত। যেমন-‘জগাই মাধাই উদ্ধার’, ‘কাজির সঙ্গে দ্বন্দ্ব’ ইত্যাদি পদগুলি রাধাকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলার কোন ভাবরস সম্বন্ধীয় নয়। সেগুলিতে কেবলমাত্র চৈতন্য জীবনের বাস্তব দিকটি সহজ-সরল ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন- গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জীবনের বিক্ষিপ্ত চিত্র—
“একদিন কহুঁ হাসি অদ্বৈত্য মন্দিরে আসি
মাঝে বমিলেন সচী কুমার।।
নিত্যানন্দ কবি সঙ্গে অদ্বৈত্য বসিয়া রঙ্গে
মোহৎসব করিনা বিচার।” (পরমেশ্বর দাস)
কিংবা:
“নীরদ-নয়নে নীর ঘন সিঞ্চনে
পুলক-মুকুল অবলম্ব ।
স্বেদ-মরন্দ বিন্দু বিন্দু চূয়ত
বিকসিত ভাবকদম্ব।।”
গোবিন্দদাসের এই পদটিতে এই চিত্র প্রেমাভাবের জীবন্ত বিগ্রহ মহাপ্রভুর চিত্র সুরধ্বনিতে উজ্জ্বল ভাবে প্রমাণ করেছেন। ‘স্বর্গীয়তরু’ কল্পতরুর কাছে তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে কৃতার্থ হচ্ছেন। এই পদটিতে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা ভাব আভাষিত হয়নি। এবং সেই কারণে এটিকে গৌরচন্দ্রিকা বলা হয়।
মহাপ্রভুর জীবন ছিল অলৌকিকতা জড়িত। রাধার ভাবে ভাবিত হয়ে তিনি লীলারসে মগ্ন থাকতেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ মহাপ্রভুর মধ্যে রাধাকৃষ্ণলীলা প্রত্যক্ষ করেছেন। শ্রীরাধার প্রেম বিকলতার কথা স্মরণ করে মহাপ্রভুর প্রেমলীলা প্রত্যক্ষদর্শী অনেক ভক্ত কবি গৌরচন্দ্রের ভাব বিলাসের বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন করেছেন। অর্থাৎ গৌরচন্দ্রিকার মধ্য দিয়ে বৃন্দাবনলীলা সম্প্রীতি গড়ে উঠেছে। যেমন—রাধামোহন রচিত একটি পদ—
“আজু হাম কি পেখলুঁ নবদ্বীপ চন্দ।
করতলে করই বয়ন অবলম্ব।।
পুন পুন গতাগতি করু ঘর পন্থ।
খেনে খেনে ফুলবনে চলই একান্ত।।”
এই পদটির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে রাধা ভাবে ভাবিত গৌরাঙ্গ এর সুগভীর কৃষ্ণ প্রেমাসক্ত ভাব ব্যঞ্জনা। কৃষ্ণ প্রেমাসক্তর এই রূপ ছিল বৃন্দাবনের প্রেমাসক্ত পূর্বরাগে রঞ্জিত রাধার। এই পদটি শোনার পর শ্রোতার মর্ম জগতে ঘনীভূত হয় রাধাই কৃষ্ণ প্রেমাসক্ত। এভাবে ক্ষেত্রটুকু প্রস্ফুটিত হয়ে গেলেই কীর্তনিয়ারা সরাসরি রাধার পূর্বরাগ জনিত রাধার হৃদয় চাঞ্চল্যের বর্ণনা দিয়ে গান শুরু করেন—
“ঘরের বাহির, দণ্ডে শতবার,
তিলে তিলে আসে যায়।
মন উচাটন, নিশ্বাস সঘন,
কদম্ব কাননে চায়।।”
শুধু পূর্বরাগ পর্যায়ে নয়, বৈষ্ণব পদাবলীর প্রতিটি ভাব পর্যায়ের গানের পূর্বে এভাবেই গৌরচন্দ্রিকা গাওয়া হয়।
গৌরচন্দ্রিকা পরিবেশনের সঙ্গে বিষয়টির মধ্যে বাঙালীর নিবিড় গৌরাঙ্গ প্রীতির পরিচয়টি পাওয়া যায়। সত্যই ‘বাঙালীর হিয়া অমিয় মথিয়া / নিমাই ধরেছে কায়া।’ গৌরচন্দ্রিকা সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। গৌরচন্দ্রিকার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণই যে গৌরাঙ্গ রূপে তুলার ধরণিতে প্রেমের ঠাকুর বিচিত্র লীলা করে গিয়েছেন শ্রোতার মনে এই ধারণাটি বদ্ধমূল হয়ে যায়। বস্তুত গৌরাঙ্গলীলার আলোকেই বৃন্দাবনলীলা যথার্থ স্বরূপটি উপলব্ধি করা যায়।