বাংলা নাট্যসাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান
নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়:
বাংলা নাট্যসাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাট্যপ্রতিভার মধ্যলগ্নে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩-১৯১৩) আবির্ভাব হয়। নাট্যসাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলালের আবির্ভাব কালকে বাংলা নাট্যসাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলা চলে। কবি ও প্রহসন রচয়িতা রূপে দ্বিজেন্দ্রলাল প্রথম পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করলেও পরবর্তীকালে তিনি নাট্যকার রূপে সাহিত্য ক্ষেত্রে সমধিক খ্যাতিমান হন।
দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকগুলি মোটামুটি চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা চলে— (ক) প্রহসন, (খ) নাট্যকাব্য, (গ) ঐতিহাসিক নাটক ও (ঘ) সামাজিক নাটক।
প্রহসন :
দ্বিজেন্দ্রলাল ছয়খানি বিদ্রূপাত্মক নাটক ও প্রহসন রচনা করেন— কল্কি অবতার (১৮৯৫), বিরহ (১৮৯৭), ত্র্যহস্পর্শ (১৯০০), প্রায়শ্চিত্ত (১৯০২), পুনর্জন্ম (১৯১১), আনন্দ বিদায় (১৯১২)। ‘কল্কি অবতার’ প্রহসনটির অধিকাংশ সমিল পদ্যে লেখা। এই প্রহসনটিতে নব্যহিন্দু, ব্রাহ্ম, রক্ষণশীল পণ্ডিত ও বিলাতফেরত—এই পাঁচটি সম্প্রদায়ের ওপর বিদ্রূপের শর বর্ষিত হয়েছে। পাঁচটি সম্প্রদায়ের বিরোধ তুঙ্গে উঠলে বিষ্ণু কল্কি অবতাররূপে আবির্ভূত হন। ‘কল্কি অবতার’ প্রহসন হিসাবে উচ্চশ্রেণীর নয়; সংলাপ দুর্বল। তবে এই প্রহসনটির অন্যতম সম্পদ এর হাসির গানগুলি। দ্বিতীয় প্রহসন ‘বিরহ’ একটি বিশুদ্ধ প্রহসন। গোবিন্দ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর তৃতীয় পক্ষের কুরূপা স্ত্রী নির্মলার কৌতুককর দাম্পত্য কলহে কাহিনীর সূত্রপাত। ইন্দুভূষণ, চপলা, রামকান্ত প্রভৃতি আলোচ্য প্রহসনের অপরাপর চরিত্র। উপকাহিনীর অতিরিক্ত প্রাধান্য নাট্যকারের আসল উদ্দেশ্যকে পরিস্ফুট হতে দেয়নি। তবে এর সঙ্গীতগুলি কৌতুকরসে পরিপূর্ণ।
‘ত্র্যহস্পর্শ’ (১৯০০) প্রহসন হিসাবে সার্থক নয়। বিবাহ বিভ্রাট কাহিনী আলোচ্য নাটকের বিষয়বস্তু। বৃদ্ধ বয়সে বিজয়গোপালের বিবাহলিপ্সা, পুত্র আনন্দগোপালের সঙ্গে কৌতুককর সংঘর্ষ, রানীর মিথ্যা মৃত্যু রটনা, বিবাহবাসরে একাধিকবার পাত্রের পরিবর্তন, পিতাপুত্রের বিবাদ-মীমাংসার মুহূর্তেই পিতামহ ও পিতৃব্যের ঈপ্সিত পাত্রীর কণ্ঠে মাল্যদান প্রভৃতি কাহিনীর দ্রুতগতিতে ও অবিশ্বাস্য পরিণতির মধ্য দিয়ে মিলন-মধুর পরিণতি লাভ করেছে। ‘প্রায়শ্চিত্ত’ (১৯০২) সমাজ বিদ্রূপমূলক প্রহসন। বিলাতফেরত সমাজের অর্থলোলুপতা, কৃত্রিমতা ও বিলাসিতার চিত্র আঁকাই প্রহসনটির উদ্দেশ্য। ‘পুনর্জন্ম’ (১৯১১) দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠ প্রহসন। আলোচ্য প্রহসনে এক কৃপণ, নির্মম ও স্বার্থপর সুদখোরের হাস্যকর পরিণতি দেখানো হয়েছে। ‘আনন্দ বিদায়’ (১৯১২) দ্বিজেন্দ্রলালের শিল্প-প্রতিভার পরিচয় বহন করে না। হাসির গান ব্যতীত এখানে উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই।
নাট্যকাব্য :
দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যকাব্যগুলির এক শ্রেণীতে আছে ‘পাষাণী’ (১৯০০), ‘সীতা (১৯০৮), ‘ভীষ্ম’ (১৯০০); আর-এক শ্রেণীতে আছে ‘তারাবাঈ’ (১৯০৩) এবং ‘সোরাব-রুস্তম’ (১৯০৮)। ‘তারাবাঈ’ ইতিহাসাশ্রিত রোমান্টিক নাট্যকাব্য; ‘সোরাব-রুস্তম’ ফিরদৌসি রচিত ‘শাহনামা’ কাহিনী অবলম্বনে অপেরা ।
‘পাষাণী’ নাটকে অহল্যা-ইন্দ্র ও গৌতমের কাহিনী রূপায়িত হয়েছে। অহল্যাকে নাট্যকার প্রণয়মুগ্ধা নারীরূপে চিত্রিত করেছেন। আলোচ্য নাটকে নাট্যকার নারীর সংস্কারমুক্ত হৃদয়াবেগকে সমাজশাসনের ঊর্ধ্বে রূপ দিতে চেয়েছেন।
‘সীতা’ নাটকের উপাদান সংগৃহীত হয়েছে রামায়ণের উত্তরকাণ্ড ও ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ নাটক থেকে। ‘সীতা’ নাটকে নাট্যকার সীতার চরিত্রে আধুনিক রোমান্টিক প্রকৃতি প্রীতি, রাম চরিত্রে কর্তব্যনিষ্ঠা ও প্রেমচেতনার দ্বন্দ্ব এবং বশিষ্ঠের ব্রাহ্মণ্য কুসংস্কার ও শূদ্রের অধিকারবোধের সংঘাতের চিত্র এঁকেছেন।
দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রকাশিত তাঁর পৌরাণিক নাটক ‘ভীষ্ম’-তে তিনি সর্বাংশে মহাভারতকে অনুসরণ করেননি। ‘ভীষ্ম’ নাটকের দ্বন্দ্ব গড়ে উঠেছে নায়কের কর্তব্য রক্ষা ও চিরকৌমার্যের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মানুষের সহজ প্রণয়াকুতি ।
ঐতিহাসিক নাটক :
নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলালের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা নির্ভরশীল তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলির ওপর। ১৯০৫-১৯০৯ পর্যন্ত রচিত দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটক রচনার কালকে ‘স্বর্ণযুগ’ বলা যেতে পারে। এই পর্বে তিনি রাজপুত ও মোগল যুগকে অবলম্বন করে ‘রাণা প্রতাপসিংহ’ (১৯০৫), ‘দুর্গাদাস’ (১৯০৬), ‘নূরজাহান’ (১৯০৮), ‘মেবার পতন’ (১৯০৮), ‘সাজাহান’ (১৯০৯)–এই পাঁচখানি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেন। ‘প্রতাপসিংহ’, ‘দুর্গাদাস’ ও ‘মেবার পতন’—নাট্যত্রয়ীতে রাজপুত ইতিহাসের প্রাধান্য এবং ‘নূরজাহান’ ও ‘সাজাহান’ নাট্যদ্বয়ে মোগল ইতিহাসের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয় ।
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসকে কেন্দ্র করে দ্বিজেন্দ্রলাল ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১) ও ‘সিংহল-বিজয়’ (১৯১৫) রচনা করেন।
রাণা প্রতাপসিংহ:
‘রাণা প্রতাপসিংহ’ নাটকের আখ্যায়িকা টডের রাজস্থান থেকে গৃহীত। রাজ্যভ্রষ্ট রাণা প্রতাপের চিতোর উদ্ধারের কঠোর সংকল্প থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় পঁচিশ বছরের কাহিনী এই নাটকে বর্ণিত হয়েছে। স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিকায় প্রতাপসিংহের শৌর্য-বীর্য, দেশপ্রেম ও অতুলনীয় আত্মত্যাগের মহিমাময় চিত্র আলোচ্য নাটকটিতে অঙ্কিত হয়েছে।
দুর্গাদাস:
‘দুর্গাদাস’ নাটকের কাহিনীও টডের রাজস্থান থেকে গৃহীত। আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষার্ধ আলোচ্য নাটকে রূপায়িত। ‘দুর্গাদাস’ নাটকে নাট্যকার হিন্দু-মুসলমানের মিলনবাণীকে রূপায়িত করতে সচেষ্ট হয়েছেন।
মেবার-পতন:
‘মেবার-পতন’ নাটকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে নাট্যকার প্রচার ধর্মিতাকে মুখ্য ভূমিকা প্রদান করেছেন। পতন উন্মুখ মেবারের অন্তিম অধ্যায়টিকে নাট্যকার পরম বেদনার সঙ্গে অঙ্কন করেছেন।
নূরজাহান :
‘নূরজাহান’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র নূরজাহান। তবে আলোচ্য নাটকে ইতিহাসের উপাদান কম। শের খাঁ-নূরজাহানের দাম্পত্যজীবন, স্বামীহত্যার প্রতিশোধের জন্য স্বামীহন্তাকে বিবাহ করার সম্মতিদান প্রভৃতি ঘটনা নাট্যকারের স্ব-কল্পিত। তবে ‘নূরজাহান’ নাটকে নাট্যকার সর্বপ্রথম শেক্সপীয়রের নাট্যরীতির রূপায়ণে আংশিক খ্যাতি অর্জন করেন।
সাজাহান:
দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকের মধ্যে ‘সাজাহান’ নাটকের শ্রেষ্ঠত্ব প্রায় অবিসংবাদিত, মঞ্চসাফল্য ও জনপ্রিয়তার দিক থেকেও বাংলা নাটকের ইতিহাসে এই নাটকটি অসাধারণ মর্যাদা লাভ করেছে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ভারত ইতিহাসের রাজনৈতিক ঘনঘটার রূপ এই নাটকে চিত্রিত। ঘটনা বিন্যাস, চরিত্র সৃষ্টি, পরিবেশ রচনা ও পরিণতি—সমস্ত দিক থেকে ‘সাজাহান’ নাটকটির মূল্য অনস্বীকার্য।
চন্দ্রগুপ্ত:
পুরাণ ও গ্রীক ইতিহাস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক রচিত। এই নাটকের প্রধান আকর্ষণ চাণক্য চরিত্র। নাটকটির গঠনরীতিতে বিচ্ছিন্নতা ও বিক্ষিপ্ততা থাকলেও মঞ্চ সাফল্যের দিক থেকে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ মঞ্চ সফল নাটক।
সিংহল-বিজয়:
‘সিংহল-বিজয়’ দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর প্রকাশিত। তবে এটিকে ঐতিহাসিক নাটক বলা যায় কিনা সে সম্পর্কে সংশয় আছে।
সামাজিক নাটক :
দ্বিজেন্দ্রলালের সামাজিক নাটক দুটি—পরপারে (১৯১২), বঙ্গনারী (১৯১৬)। সামাজিক নাটক রচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল মৌলিকত্ব দেখাতে পারেননি।
‘পরপারে’ নাটকের বিষয়বস্তু দুর্বল এবং পরিণতি অত্যন্ত আকস্মিক। স্ত্রীর জন্য মাকে পরিত্যাগ, মদ্যপান, গুলি করা, ফেরারী আসামির জীবনযাপন, সর্বশেষে দীক্ষা গ্রহণ প্রভৃতি এই নাটকে এমন দ্রুতগতিতে ঘটেছে যে এখানে কোন শিল্পোৎকর্ষ বা ভাব গভীরতা নেই।
‘বঙ্গনারী’ নাটকে নাট্যকার বাল্যবিবাহ ও পণপ্রথা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। জীবনের শেষ প্রহরে দ্বিজেন্দ্রলাল সামাজিক নাটক রচনায় মনোনিবেশ করলেও কোন নতুন দিক নির্দেশ করতে পারেননি।
দ্বিজেন্দ্রলালের সৃষ্টির মূল্যায়ন :
নাট্যশৈলীগত নানা ত্রুটি ও প্রতিভার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলা নাটকের ইতিহাসে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার বিশিষ্টতা অনস্বীকার্য। তাঁর নাটকের অধিকাংশ সংলাপই উচ্ছ্বসিত ও ভাবাবেগ মণ্ডিত। তাঁর নাটকের মঞ্চ সাফল্যের অন্যতম কারণ ঐশ্বর্য সমৃদ্ধ ভাষা। নাটকের গঠনরীতির দিক থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল স্বগতোক্তি বর্জন করেছেন, শেক্সপীয়রীয় নাট্যশৈলীর দিকে দৃষ্টি প্রদান করেছেন, এবং নাটকীয় গঠনরীতির দিক থেকে রোমান্টিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকের চরিত্রগুলি গতিচঞ্চল ও অন্তর্দ্বন্দ্বময় (যেমন সাজাহান, চাণক্য, ঔরঙ্গজেব, নূরজাহান)। ট্র্যাজেডি পরিকল্পনার দিক থেকে তাঁর ‘সাজাহান’ এবং ‘নূরজাহান’ অবশ্যই স্মরণীয়। দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা নাটককে আধুনিক নাট্যরীতির বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত করতে চেয়েছিলেন। বাংলা নাট্যসাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলালের ভূমিকা নির্ণয় প্রসঙ্গে সমালোচক রথীন্দ্রনাথ রায় যথার্থই বলেছেন—“দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকে অতিনাটকীয়তা, উচ্ছ্বাসবাহুল্য ও আতিশয্যজনিত বহু ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, কিন্তু এই দোষগুলির জন্য বাংলা নাটকে তাঁর দানকে অস্বীকার করা যায় না। অন্তর্দ্বন্দ্ববহুল চরিত্র সৃষ্টি, উজ্জ্বল বলিষ্ঠ সংলাপ রচনা, নাটকীয় চমৎকারিত্ব, নূতন টেকনিক প্রয়োগ, শেক্সপীরীয় নাট্যকলার সার্থক প্রয়োগ, নাটকে আধুনিক চিন্তাচেতনার প্রবর্তন প্রভৃতি বিষয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা নাটকে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী।”