উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের জীবনবৃত্তান্ত ও রচনাবলীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার
জীবনবৃত্তান্ত:
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ইংরেজী সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার, শুধু এলিজাবেথীয় কালেই নয়, ইংরেজী সাহিত্যের সর্বকালেরই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার। আবার শুধুমাত্র নাট্যকারই নন, ‘শেক্সপিয়ার নিজেই একটি জগৎ, জীবনের রূপশালা' বলাও বোধ হয় অত্যুক্তি নয়। শুধু ইংরেজী সাহিত্যেই নয়, পৃথিবীর সব দেশের সব ভাষার রসিক জনের কাছেই শেক্সপিয়ারের রচিত নাটক আর গীতিকবিতাগুলির আবেদন ষোড়শ শতাব্দী থেকে এই একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অপরিসীম, তার প্রভাবও অমলিন। তার রচিত নাটকগুলির অভিনয় তার কালের বিদ্বোৎজনের সাথে সাথে সাধারণ নগণ্য সহিস গাড়োয়ানরা যেমন উপভোগ করত আজো তেমনি সাধারণ মানুষ তাকে সমানভাবেই উপভোগ করে। “তাই অপ্রচলিত শব্দাদি মাঝে মাঝে থাকলেও সাহস করে শেক্সপিয়ার পাঠ করলে আমরাও দেখবো শেক্সপিয়ার দুর্বোধ্য লেখক নন—বরং আধুনিক ইংরেজ কবি বা বাঙ্গালী কবিদের অপেক্ষা তাঁর লেখা সহজবোধ্য। অপরিমেয় শুধু তার প্রতিভা।” (ইংরেজী সাহিত্যের রূপরেখা—গোপাল হালদার )
এই অপরিমেয় প্রতিভাধর মহাকবি ও নাট্যকারের জীবনকাহিনী কিন্তু নানা ধরনের তথ্যের অনিশ্চয়তা ও জটিলতার কারণে আজও অনেকটাই অনুমান নির্ভর। তবু একথাও ঠিক যে ইংরেজী সাহিত্যের অধিকাংশ কবি ও লেখকদের মত জীবিকার দুর্ভাবনামুক্ত অভিজাত অবস্থাপন্ন বংশে শেক্সপিয়ার জন্মগ্রহণ করেননি। ইংলন্ডের অ্যাভন নদীর তীরে স্ট্র্যাটফোর্ড গ্রামের যে পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাকে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারই বলা যেতে পারে। জন ও মেরী শেক্সপিয়ারের তৃতীয় সন্তান উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের জন্ম ১৫৬৪ খ্রিঃ সম্ভবত ২৩ এপ্রিল এবং ৫২ বৎসর পরে ১৬১৬ খ্রিঃ সেই ২৩ এপ্রিলেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। পিতা জন ছিলেন একজন পৌর প্রতিনিধি, পাশাপাশি দস্তানা নির্মাণ ও খামারের কাজ সহ আরো নানা রকমের পেশাতেও নিযুক্ত ছিলেন। মা মেরী আর্ডেন ছিলেন কৃষিজীবী পরিবারের মেয়ে। জমিজমা ও ছোটখাট বিকিকিনির ব্যবসায় প্রথম দিকে সে সংসারে সচ্ছলতা ছিল। স্ট্যাফোর্ড শহরের অবৈতনিক গ্রামার স্কুলেই ছোট্ট উইলিয়ামের প্রাথমিক শিক্ষার শুরু হলেও ১৫৭৭ খ্রিঃ পরিবারের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটায় তাকে বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে এনে পিতার ব্যবসায় লাগানো হয়েছিল। ১৫৮২তে আঠারো বছর বয়সী উইলিয়াম শেক্সপিয়ার কাছাকাছি মার্টারি গ্রামের জনৈক রিচার্ড হ্যাথওয়ের মেয়ে ২৫ বছর বয়সী এ্যানি হ্যাথওয়েকে বিয়ে করেন। কিছুকাল একটা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত থেকেও অবশেষে আর্থিক অনটনের চাপে ভাগ্যান্বেষণে উইলিয়াম যখন ১৫৮৪ খ্রিঃ লন্ডন শহরে চলে এলেন তখন তিনি তিনটি পুত্র কন্যার পিতা। “গ্রাম ত্যাগের কারণ জীবিকার দায়ও হতে পারে বা নিকটবর্তী জমিদারের হরিণ-চুরি করে খাওয়ার জন্য চাবুকাঘাতের লজ্জাও হতে পারে—এবং দুইই হতে পারে।” লন্ডনের মত বিশাল শহরে তরুণ উইলিয়ামকে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সুদীর্ঘ ছয় বৎসর ধরে অনেক কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছিল। এই সময় 'অনেক কঠিন শ্রমসাধ্য কাজের সাথে সাথে তাকে রঙ্গশালার বাইরে অতিথিদের ঘোড়া সামলাবার কাজও করতে হয়।
অবশেষে তিনি তার প্রতিভার স্বীকৃতি পেলেন। লন্ডন শহরের রঙ্গমঞ্চে অভিনেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেলেন। ঘোড়ার পাহারাদার থেকে শিক্ষানবীশ নট হিসাবে তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার যে সুযোগ পেলেন তাতে প্রচলিত বা অপ্রচলিত নাটক কেটে ছিঁড়ে, জোড়াতালি দিয়ে অভিনয়োপযোগী করে দেওয়াই ছিল তার কাজ। সে কাজে ঐ নাট্যশালাই হল তার নাট্যমন্দির, তাঁর বিদ্যামন্দির আর উচ্চ-নীচ ভদ্র-ইতর দর্শককুলের বিচিত্র জগৎই হল তার বিশ্ববিদ্যালয়। শেক্সপিয়ারের সাহিত্যিক জীবন শুরু হল। কবিতা, নাটক রচনা করাই তখন তাঁর প্রধান কাজ ।
এরপরই শেক্সপিয়ার লর্ড চেমবারলেনের অভিনেতা সংঘের (Lord Chamberlains Company of Actors) এর সদস্য হলেন। এদের নাটকগুলি অভিনীত হত থিয়েটার, কার্টেন, গ্লোব ও ব্ল্যাকসায়ার্স রঙ্গমঞ্চগুলিতে। অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক রচনার সূত্রে তখন কবি নাট্যকার শেক্সপিয়ার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। অর্থোপার্জনের মাত্রাও বিরাট উচ্চতায় উঠেছে। রানী এলিজাবেথের মৃত্যুর পর রাজা প্রথম জেমসের সময়ে তার জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পেল। তার দলের নতুন নাম হল The King's Company। এলিজাবেথীয় নাটকের ইতিহাসে শেক্সপিয়ারের নাটক কিংবদন্তিতে পরিণত হল।
১৬১০ খ্রিঃ শেক্সপিয়ার লন্ডন ছেড়ে স্ট্র্যাটফোর্ডে ফিরে এসে ১৫৯৩ খ্রিঃ তার নিজের কেনা ‘নিউ প্লেস' নামের বিশাল অট্টালিকায় বসবাস করতে আরম্ভ করলেন। এখান থেকেই তিনি তার শেষ পর্বের নাটকগুলি লিখেছিলেন। যে রঙ্গমঞ্চেও তিনি একসময় অভিনয় করতেন পরে সেই রঙ্গমঞ্চেরই তিনি একজন স্বত্তাধিকারী হয়েছিলেন। পরে আবার তা বিক্রী করে দিয়েই লন্ডন থেকে স্ট্রীটফোর্ডে ফিরে গিয়েছিলেন। তবু নাটকের সহকর্মীদের সাথে ১৬১৩ খ্রিঃ পর্যন্ত তার যোগাযোগ ছিল। ঐ বছরেই অষ্টম হেনরী নাটকটি অভিনয় কালে গ্লোব থিয়েটার আগুনে ভস্মীভূত হয়। এর তিন বৎসর পরেই মাত্র ৫২ বৎসর বয়সে ১৬১৩ খ্রিঃ ২৩ এপ্রিল এই মহান নাট্যকারের জীবনাবসান হয়। সেই দিনটিই ছিল তার জন্মদিন।
শেক্সপিয়ারের রচনাপঞ্জী, চরিত্রলক্ষণ ও প্রকাশকাল নিয়ে আলোচনায় অধ্যাপক কুন্তল চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণটি আশ্রয় করা যায়। তাঁর ভাষায়—“শেক্সপিয়ারের জীবন বৃত্তান্তের নানা ঘটনা নিয়ে যেমন অনিশ্চয়তা ও সংশয় রয়েছে তেমনি বিতর্ক রয়েছে তার বিভিন্ন রচনার সময়কাল, কিছু রচনার প্রামাণিকতা, মারলোর কাছে তাঁর ঋণ ইত্যাদি বহু বিষয়ে। শেক্সপিয়ারের নাটকগুলির যাবতীয় পাণ্ডুলিপি বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং তার নিজের দ্বারা মুদ্রিত এই সব রচনার কোন সংস্করণ না থাকায় এ জাতীয় বিতর্কের কখনো সংশয়াতীত নিরসন হবে বলে মনে হয় না। তাঁর জীবদ্দশায় যদিও ষোলটি নাটকের কোয়ার্টো (Quarto) সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল তবু সেগুলিকে লেখক কর্তৃক অনুমোদিত স্বীকৃত সংস্করণ বলে গ্রাহ্য করা হয় না। শেক্সপিয়ারের রচনা সমূহের প্রথম ফোলিও (First Folio ) সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৬২৩এ নাট্যকারের দুই সহকর্মী--জন হেমিঞ্জেস (Heminges) এবং হেনরি কনডেল (Condell) এর যুগ্ম সম্পাদনায়। এই প্রথম স্বীকৃত সংস্করণের পেরিক্লেস ছাড়া (Pericles) অন্য সমস্ত নাটক স্থান পেয়েছিল। অবশ্য এই নাটকগুলির রচনা কালের কোন উল্লেখ এই গ্রন্থে করা হয়নি এবং নাটকগুলি রচনার ধারাবাহিকতার ক্রমানুযায়ী সাজানোও ছিল না।” (ইংরেজী সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়) ১৫৮৮ থেকে ১৬১২ খ্রিঃ মোটামুটিভাবে এই চব্বিশ বছরের মধ্যে শেক্সপিয়ার মোট ৩৫টি নাটক লিখেছিলেন। আরো কয়েকটি নাটকেও তাঁর হাত লেগেছিল, তবে সেগুলি খুব একটা গ্রহণীয় নয়। এছাড়াও লিখেছেন মোট ১৫৪টি সনেট ও তিনটি আখ্যানধর্মী কাব্য । তাঁর এই চব্বিশ বছরের রচনাকালে তিনি ইংলন্ড ও রোমের ইতিহাসকে আশ্রয় করে লিখেছেন ঐতিহাসিক নাটক, লঘু ও গম্ভীর কমেডির দু'ধরনের শাখাকে আশ্রয় করে লিখেছেন বেশ কিছু কমেডি, আর আছে গভীর বেদনা ও ভয়ঙ্করতা রসে রসোতীর্ণ ট্র্যাজেডি। মোটামুটিভাবে রচনা কালকে চারভাগে ভাগ করে নেওয়া যায় ৷
প্রথম পর্ব—১৫৮৮ থেকে ১৫৯৪ খ্রিঃ পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্ব–১৫৯৬ থেকে ১৬০৯ খ্রিঃ পর্যন্ত
তৃতীয় পর্ব–১৬০১ থেকে ১৬০৪ খ্রিঃ পর্যন্ত
এবং চতুর্থ পর্ব–১৬০৩ থেকে ১৬১২ খ্রিঃ পর্যন্ত।
এই চব্বিশ বছরে তাঁর রচিত নাটকগুলিকেও চারভাগে বিভক্ত করে একটি তালিকা তৈরি করা যায়।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের রচনাবলী:
(ক) ঐতিহাসিক নাটক (মোট সংখ্যা ১০টি)
১. ষষ্ঠ হেনরী (Henry VI - 3 parts, 1591-92)।
২. তৃতীয় রিচার্ড (Richard III, 1592-93)।
৩. রাজা জন (King John, 1596 )।
৪. চতুর্থ হেনরী (Henry IV - 2 parts 1597-98)।
৫. পঞ্চম হেনরী (Henry V, 1597-98) ।
৬. জুলিয়াস সিজার (Julius Caeser, 1599)।
৭. ক্যারিওল্যানাস (Cariolanus, 1603)।
৮. টিমন অব এথেন্স (Timon of Athens, 1608 ) ।
৯. পেরিক্লিস (Paricles, 1608)।
১০. অষ্টম হেনরী (Henry VIII, 1612)।
(খ) বিয়োগান্তক নাটক বা ট্র্যাজেডি (মোট সংখ্যা ৭টি)
১. টাইটাস এ্যাড্রোনিকাস (Titus Andronicus, 1594)।
২. রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট (Romeo and Juliet, 1594)।
৩. হ্যামলেট (Hamlet, 1601)।
৪. ওথেলো (Othello, 1604)।
৫. রাজা লীয়ার (King Lear, 1605)।
৬. ম্যাকবেথ (Macbeth, 1606)।
৭. এ্যান্টনি এ্যান্ড ক্লিওপেট্টা (Antony and Cleopatra, 1606-07)।
(গ) হাস্যরসাত্মক নাটক বা কমেডি (মোট সংখ্যা ১৬টি)
১. দি কমেডি অব এররস (The Comedy of Errors, 1593)
২. টু জেনটেলম্যান অব ভেরোনা (Two Gentlemen of Verona, 1594)
৩. লাভস্ লেবরস লষ্ট (Loves Labours Lost, 1594)
৪. ট্রেমিং অব দি শ্রু (Taming of the Shrew, 1594)
৫. এ মিড সামার নাইটস ড্রিম (A Mid Summer Nights Dream, 1596)
৬. দি মার্চেন্ট অব ভেনিস (The Merchant of Venice, 1596)
৭. ম্যাচ এ্যাডো অ্যাবাউট নাথিং (Much Ado About Nothing. 1598 )
৮. দি মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসর (The Merry Wives of Windsor, 1600)
৯. অ্যাজ ইউ লাইক ইট (As you Like It, 1600)
১০. টুয়েলফথ্ নাইট (Twelfth Night, 1601)
১১. ট্রয়লাস এ্যান্ড ক্রেসিডা (Troilus and Cressida, 1602)
১২. অলস ওয়েল দ্যাট এনডস ওয়েল (All's Well That Ends Well, 1602)
১৩. মেজার ফর মেজার ( Measure for Measure, 1604)
১৪. সিমবেলিন (Cymbeline, 1610)
১৫. দ্য উইন্টার্স টেল (The Winters Tale, 1610)
১৬. দি টেমপেষ্ট (The Tempest, 1611 )
(ঘ) আখ্যানধর্মী কাব্য (মোট সংখ্যা ৩টি)
১. ভেনাস এ্যান্ড অ্যাডেনিস (Venus and Adonis, 1593)
২. দি রেপ অব লুক্রিস (The Rape of Lucrece, 1594)
৩. দ্বিতীয় রিচার্ড (Richard II, 1596)
(ঙ) কবিতা/সনেটগুচ্ছ—
মোট সংখ্যা ১৫৪টি, রচনাকাল ১৬০৯।