রূপক-সাংকেতিক নাটকের সংজ্ঞা ও স্বরূপ
রূপক, সাংকেতিক ও প্রতীক এই তিনটি শব্দ বর্তমানে শিল্প সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়। নাটকের ক্ষেত্রে অ্যালিগোরিকাল ও সিম্বলিকাল শব্দ দুটি প্রযুক্ত হয়। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি নাটককে রূপক নাট্য, সাংকেতিক নাট্য, প্রতীকি নাট্য, তত্ত্বনাট্য, রূপক-সাংকেতিক নাট্য প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। অ্যালিগোরি ও সিম্বলিক শব্দ দুটির মধ্যে যে পার্থক্য আছে তার উপর ভিত্তি করে সব সময় নাটকের শ্রেণীবিভাগ করা সম্ভব হয় না। ফলে নাটকের শ্রেণীবিভাগের ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
সংস্কৃত আলঙ্কারিক ধনঞ্জয় নাট্যকে রূপ নামে অভিহিত করেছেন। নাট্য যেহেতু দৃশ্য সেহেতু এর নাম রূপ। আলঙ্কারিক বিশ্বনাথের মতে, নাট্যের পাত্রপাত্রীর রূপ নট-নটীতে আরোপিত হয় বলে এর নাম রূপক। পাত্র পাত্রীর রূপ নট-নটীতে আরোপ করে নাট্য দৃশ্য হওয়ার জন্যই রূপ বা রূপক রূপে অভিহিত হয়। অবশ্য রূপক শব্দটির যে অর্থ সেই অর্থে শব্দটি নাটকে ব্যবহৃত হয়নি। যখন Allegorical Drama এর বাংলা করা হয় রূপক নাট্য, তখন Allegory বলতে বোঝায় - "A figurative, narrative or description conveying a valid moral meaning”, অর্থাৎ রূপক হল এমন এক বিশেষ ধরনের আখ্যান বা বর্ণনা যার তলদেশে একটি নীতিপূর্ণ অর্থ আছে। অলঙ্কার শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, রূপক হল এমন এক রূপ, আলঙ্কারিক প্রয়োগ যেখানে বাইরের আখ্যানের অন্তরালে আরো একটি দ্বিতীয় অর্থ নিহিত থাকে; অর্থাৎ রূপক সাংকেতিক নাটকের বাইরের আখ্যান গৌণ, দ্বিতীয় আখ্যানটি মুখ্য। এই মুখ্য অর্থকে বিভিন্ন রূপকের মাধ্যমে উপস্থিত করতে হয়। এই জাতীয় রচনায় কাহিনী থাকতে পারে বা বর্ণনামূলক কোন ঘটনাও থাকতে পারে। এই জাতীয় রচনায় কাহিনীর একটি বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ অর্থ থাকবে। নাটকের ক্ষেত্রে কাহিনী এবং রূপকার্থ কাছাকাছি থাকে। এই কাহিনীর অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ অর্থ নিয়ে সমান্তরালভাবে নাটক তার দ্বন্দ্বময় কাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়। সমান্তরালভাবে কাহিনী তার গৌণ অর্থ ও উদ্দিষ্ট অর্থ নিয়ে প্রবাহিত হয়।
উনিশ শতকে পাশ্চাত্য দেশে যে symbolic আন্দোলন দেখা দিল এবং তার ফলে যে নাট্য রচনার উদ্ভব হল, সেগুলো ঠিক পূর্ববর্তী কালের মতো নীতি সর্বস্ব রচনা নয়। এই সময় থেকে সাংকেতিক, প্রতীকি প্রভৃতি শব্দগুলি symbolic-এর প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হতে লাগল । পূর্ববর্তীকালে রূপক রচনায় বাইরের কাহিনীর মধ্য থেকে ভিতরের অর্থ বুঝতে হত। কিন্তু বর্তমানে এমন এক ধরনের রূপক গড়ে উঠল যেখানে বাইরের কাহিনীর ফাঁকে মাঝে মাঝে ভিতরের অর্থকে আভাসিত করার চেষ্টা হয়েছে। এই জাতীয় রচনাকে মিশ্র রূপক বলে, সাধারণত এ জাতীয় কাহিনীতে রূপক এবং সংকেতের মিশ্রণ ঘটে এবং কাহিনীর ফাঁকে ফাঁকে ভিতরের অর্থকে আভাসিত করার জন্য কখনও কখনও সংকেতের অনুপ্রবেশ ঘটে।
কোন সময়ে দেখা যায় বস্তু, ধ্বনি বা চরিত্রকে আশ্রয় করে গভীর অর্থ সংকেতিত হয়। নাটকে যদি এই জাতীয় রীতি অবলম্বিত হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, রচনাটি রূপক ও সংকেতের মিশ্রণ। যদি কোন নাটকে রূপক ও সংকেতের মিশ্রণ ঘটে তবে তাকে রূপক সাংকেতিক নাটক বলে। যদি নাটকটি গভীর, অনির্দেশ্য বা অরূপ তত্ত্বজ্ঞাপক হয়, নাটকটি রূপক জাতীয় হলেও সেখানে সংকেত প্রয়োগ প্রাধান্য লাভ করবে। সুতরাং রূপক রচনার রীতিও তিন প্রকার—
(১) এক জাতের রচনাতে সংকেত নেই কিন্তু বাইরের অর্থের গভীরে ভিতরের নীতি তত্ত্ব আছে।
(২) আর এক জাতের রচনায় সংকেত থাকলেও তা মুখ্য না—এবং সেখানে গূঢ় তত্ত্ব কথা প্রকাশিত হয়।
(৩) আর এক জাতের রচনা রূপক হতে পারে যেখানে অরূপ তত্ত্বকথা মুখ্য এবং তাকে বোঝানোর জন্য রূপকধর্মী রচনায় প্রচুর সংকেতের প্রয়োগ করা হয়েছে।
বিষয়বস্তু অনুযায়ী প্রথম শ্রেণীর নাটককে বিশুদ্ধ রূপক নাটক, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাটককে মিশ্র রূপক নাটক এবং তৃতীয় শ্রেণীর নাটককে সংকেত মুখ্য রূপক নাটক বলা যেতে পারে। এই শেষোক্ত শ্রেণীর নাটককে সাংকেতিক বা প্রতীকি নাটকও বলা যেতে পারে। কিন্তু এখানে রূপক রীতি বর্জিত হয় না বলে একে রূপক সাংকেতিক নাটকরূপে অভিহিত করাই সমীচীন ৷
সাংকেতিক নাটক কাকে বলে আলোচনার আগে সংকেত, সাংকেতিক, প্রতীক প্রভৃতি শব্দগুলির অর্থ জানা দরকার। সংকেত বলতে বোঝান হয় কোন প্রতীক বা চিহ্নকে অর্থাৎ কখনও শব্দ বা ধ্বনির সাহায্যে বা ইশারায়-ইঙ্গিতে অভিপ্রায় প্রকাশের চেষ্টা হলে তার নাম হয় সাংকেতিক। নাটকের ক্ষেত্রে সাংকেতিক শব্দটি ব্যঞ্জনা বা ইঙ্গিত অর্থে ব্যবহৃত হয়। কোন একটি বস্তুর সাহায্যে যদি কোন গূঢ় অব্যক্ত, অনির্দেশ্য অতীন্দ্রিয় বা আধ্যাত্মিক কোন কিছুর আভাস ব্যঞ্জিত হয় তবে তা হয়ে যায় সাংকেতিক নাটক। এই জাতীয় নাটকে কোন বস্তুকে ব্যঞ্জিত অর্থে প্রতীক বা সংকেত রূপে দাঁড় করানো হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’, ‘ডাকঘর’, ‘রক্তকরবী’, ‘রাজা’ প্রভৃতি এই জাতীয় নাটক। মুক্তধারা নাটকের পর, ভৈরব মন্দির, রক্তকরবী নাটকের জাল, বাজপাখি, মরা ব্যাঙ, কুন্দমালা, রক্তকরবীর গুচ্ছ প্রভৃতি সংকেত বা প্রতীকি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে ব্যবহৃত বস্তুগুলি নিজস্ব অর্থ ব্যতীত একটি গূঢ় গভীর ভাবের ইঙ্গিত দান করে।
রূপক বা সাংকেতিক রচনার পার্থক্য নির্ণয় প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ করা চলে—
(১) সংকেত হল অদৃশ্য বা অরূপ সত্তার সম্ভাব্য রূপ, রূপক হল পরিচিত তত্ত্বের সম্ভাব্য অনেক রূপের মধ্যে একটি রূপ।
(২) সংকেত হল অনুভবের ব্যাপার, রূপক হল জ্ঞানের ব্যাপার এবং বুদ্ধির সাহায্যে তা উপলব্ধি করা যায়।
(৩) সংকেত আধ্যাত্মিক, নিগূঢ় তত্ত্বকে পরিস্ফুট করে।
(৪) সংকেত সত্যের অপরোক্ষ অনুভূতি আর রূপক হল পরিচিত জগতের জ্ঞানের দিক। এই বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাংকেতিক রচনা সূক্ষ্ম, গভীর ও ব্যঞ্জনাময় ।
রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী' নাটকে রূপক এবং সংকেতের মিশ্রণ ঘটেছে—এখানে নাটকের আপাত কাহিনীর অন্তরালে ধনতান্ত্রিক সভ্যতার বীভৎস রূপ দেখানো হয়েছে এবং কয়েকটি সংকেতকে অবলম্বন করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। রূপক নাটকের একটি অস্পষ্ট ভাবকে কাহিনীর ছদ্মবেশে উপস্থিত করা হয়। সেই ভাবটি রূপকের আবরণে না বলাও যেতে পারে। কিন্তু সরাসরি উপস্থিত করলে বাধা আসতে পারে, তাই রচয়িতা রূপকের আশ্রয় গ্রহণ করেন। কখনও কখনও আবার এই জাতীয় নাটকে সংকেতের আশ্রয়ও গ্রহণ করতে হয়। নাটকে রূপকের প্রাধান্যের সঙ্গে সঙ্গে সংকেতের প্রয়োগ ঘটলে তাকে রূপক-সাংকেতিক নাটক বলে। বাংলা নাট্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের রাজা, ফাল্গুনী, ডাকঘর, মুক্তধারা, অচলায়তন এগুলিকে রূপক-সাংকেতিক নাটক বলা যায় এবং রবীন্দ্রনাথ এ জাতীয় নাট্য রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন ধারার সূত্রপাত করেছেন ।