শাক্তপদকর্তা রামপ্রসাদ সেনের কবি কৃতিত্ব
রামপ্রসাদ ছিলেন তান্ত্রিক সাধক। তন্ত্র সাধনার নানা রকম রূপের মধ্যে একটি রূপ হল উপাস্য দেবীর সঙ্গে একীভূত হয়ে সাধকের মাতৃ রূপে কল্পনা করে সাধনা করা। এই সাধনামার্গের কথাই তিনি নানা গানে নানা ভাবে প্রকাশ করেছেন। তত্ত্বাশ্রয়ী হলেও পদগুলি কাব্যগুণ লাভ করেছে এবং এখানেই রামপ্রসাদের সাধকসত্ত্বা ও কবিসত্ত্বার মিলন ঘটেছে। জন্মান্তর বাদে বিশ্বাসী কবি জন্ম-জন্মান্তরের দুঃখ ভোগের কারণ স্বরূপ কর্মফল বাদকেই স্বীকার করেছেন। তবুও অভিমানে কবি জননীর কাছে অভিযোগ করেছেন—
“মা আমায় ঘুরাবি কত
কলুর চোখ বাঁধা বলদের মত।।”
কিংবা—
“বল মা আমি দাঁড়াই কোথা
আমার কেহ নাই শঙ্করী হেথা।”
এইভাবে মায়ের কাছে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেছেন।
সাধক রামপ্রসাদ সাংসারিক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণাকে গ্রাহ্য করেন না—তিনি শুধু মাতৃকৃপা ভিক্ষুক। তাই তিনি অক্লেশে বলতে পারেন—
“প্রসাদ বলে, ব্রহ্মময়ী, বোঝা নামাও ক্ষণেক জিরাই।
দেখ সুখ পেয়ে লোক গর্ব করে আমি করি দুখের বড়াই।।”
—মাতৃসাধক রামপ্রসাদের শেষ কথা—
“অর্ধ অঙ্গ জায়গীর মা
তবু শিবের মাইনে ভারি
আমি বিনা মাইনের চাকর
কেবল চরণধূলার অধিকারী।”
রামপ্রসাদের জীবনদর্শ তাঁর রচিত গানে প্রকাশ পেয়েছে এইভাবে। আবার—
“জাঁকজমকে করলে পূজা অহঙ্কার হয় মনে মনে।
তুমি লুকিয়ে তারে করবে পূজা জানবে না রে জগৎজনে
ধাতু পাষাণ মাটীর মূর্ত্তি কাজ কিরে তোর সে গঠনে।
তুমি মনোময় প্রতিমা গড়ি বসাও হৃদি পদ্মাসনে।”
এই সহজ ধারার জন্যই তাঁর গীতিকবিতার গীতি প্রবণতা সমঘ্র বাংলাদেশের চাষি, তাঁতি, জেলে, মজুর, মাঝি-মাল্লা, কামার-কুমোর এই মৃত্তিকা সংলগ্ন সকল প্রকার মানুষকে সহজে আকর্ষণ করেছে। তারা অনায়াসে রামপ্রসাদের গানকে আপন কণ্ঠে গ্রহণ করেছে।
হিমালয়-মেনকার একমাত্র কন্যা উমাকে শিবের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পতিগৃহে। তাকে অবলম্বন করে ‘আগমনী-বিজয়া’র গানগুলি রচিত হয়েছে। হিমালয়-মেনকা, উমা-শঙ্কর এর কাহিনী পুরাণ কেন্দ্রিক হলেও শাক্ত পদাবলীতে এযেন বাঙালী মধ্যবিত্ত এক পরিবারের ছবি। আত্ম ভোলা সংসার অনাসক্ত স্বামীর গৃহে কন্যার সম্ভাব্য দুঃখময় জীবনের কথা স্মরণ করে তাকে কদিনের জন্য কাছে এনে রাখা এবং তিন দিন বাদে তাকে বিদায় দান করার মধ্য দিয়ে মাতৃ হৃদয়ের যে বিচিত্র অনুভূতি তারই আশ্চর্য সজীব চিত্র ‘আগমনী-বিজয়া’র পদগুলিতে রয়েছে। রামপ্রসাদের এজাতীয় পদে আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের চালচিত্রের দু-একটি দুর্লভ মুহূর্তের সন্ধান পায়। মা মেনকার কন্যা উমাকে কোলের কাছে বসিয়ে মাথায়-মুখে হাত বুলিয়ে মেয়ের কুশল সংবাদ জানতে চায়।
রামপ্রসাদের আগমনী-বিজয়াতে আছে তৎকালীন সমাজ চিত্র, চিরকালীন মাতৃ হৃদয়ের ব্যাকুলতা এমনকি বিশ্ব জননীকে কন্যা রূপে কল্পনার মধ্য দিয়ে ভারতীয় আধ্যাত্ম সাধনার গূঢ় রসও এতে বিবৃত। কিন্তু এর প্রধান আকর্ষণ পদের সহজ সরল অকপট প্রাণরসে পূর্ণ ভাষা এবং ভাষারূপের সঙ্গে বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনের ঘনিষ্ঠ পরিচয়।
“গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাবো না।
বলে বল্বে লোকে মন্দ, কারো কথা শুন্বো না।।
যদি এসে মৃত্যুঞ্জয়, উমা নেবার কথা ক’য়—
এবার মায়ে-ঝিয়ে কর্বো ঝগড়া, জামাই বলে মান্ব না।। ”
কিন্তু বাস্তব সংসার বড় কষ্টের ‘যেতে নাহি দিব’ বললেও যেতে দিতে হয়। তাই বিজয়া প্রভাতে যখন মেঘের ডমরু বাজিয়ে শঙ্কর উমাকে নিয়ে যায় তখন হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে মায়ের প্রচেষ্টা।
ভাষা-ছন্দ-অলংকার প্রয়োগে রামপ্রসাদ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। জীবনের অতি পরিচিত বাস্তব ঘটনাগুলিকে তিনি তাঁর কাব্যে স্থান দিয়েছেন। অনায়াসে তাঁর কাব্যকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এজন্য বাঙালীর নিজস্ব সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের শ্রমে ও সেবায়, বৈরাগ্য ও ব্যর্থতায়, প্রার্থনা ও বার্ধক্যে, স্নেহ-বুভুক্ষায় কম্পিত মুহূর্তে কিংবা ভক্তির ক্রন্দনে রামপ্রসাদই গান তাই নৈসর্গিক আবেদনের বাণীরূপ। শেষ পর্যন্ত আমরা ড. অরুনকুমার বসুর কথাতে বলতে পারি—“রামপ্রসাদ জগৎজননীর চরণে কেবল সাধনার জবাপুষ্প, বিল্বপত্রই অর্পণ করেননি, বেদনার রসে বাৎসল্যের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার হয়ে উঠেছেন।”