-->

শাক্তপদাবলীর সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন-উত্তর

 

শাক্তপদাবলীর সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন-উত্তর

১. অষ্টাদশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য কাব্যবৈচিত্র্য বলতে কীসের কথা মনে পড়ে ?

উ: অষ্টাদশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য কাব্যবৈচিত্র্য বলতে শাক্তপদাবলীর কথাই মনে আসে।

২. শাক্ত গান কাকে বলে ?

উ: শাকে অর্থাৎ উমা-পার্বতী-দুর্গা-কালিকাকে কেন্দ্র করে যে গান রচিত হয় তাকে বলা হয় শাক্ত গান ।

৩. শাক্ত পদাবলীর অপর নাম কী?

উ: পদাবলীর অপর নাম মালসী।

৪. শাক্ত পদাবলী কোন রাগে গীত হত ?

উ: শাক্ত গান মানবশ্রী রাগে গাওয়া হত। তাই এর অপর নাম মালসী।

৫. কোন বেদে আমরা এই আদ্যাশক্তির উল্লেখ পাই ?

উ: বেদের সূক্তেও আমরা আদ্যাশক্তির উল্লেখ পাই।

৬. কোথায় কোথায় মূলত দেবীর উল্লেখ পেয়ে থাকি ?

উ: মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, কালিকা পুরাণ প্রভৃতিতে দেবীর আখ্যান নানাভাবে উল্লেখিত হয়েছে।

৭. শাক্তপদ কাকে বলে ?

উ: বাংলাদেশে সর্বশক্তিময়ী আদ্যাশক্তিকে দুর্গাবরূপে ভক্তি বা বাৎসল্যের দৃষ্টিতে দেখে একপ্রকার অতি চমৎকার পদসাহিত্যের সৃষ্টি হয়, তাকে শাক্তপদ বলে।

৮. শাক্ত সাহিত্যে প্রধানত কী রস স্থান পেয়েছে?

উ: বাংলাদেশের শাক্তপদে বাৎসল্যরস ও স্নেহভক্তির একনিষ্ঠ আবেগ প্রকাশিত হয়েছে।

৯. শাক্ত পদাবলীর গান কী নিয়ে রচিত ?

উ: শাক্ত পদাবলীর বেশ কিছু গান উমার বাল্যলীলা ও হরপার্বতীর কাহিনি নিয়ে রচিত।

১০. শাক্ত গানের শ্রেষ্ঠ অংশের নাম কী ?

উ: শাক্ত গানের শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের নাম 'আগমনী' 'বিজয়া'-র গান।

১১. বৈষ্ণব পদাবলী আর শাক্ত পদাবলীর মূলরস কী ?

উ: বৈষ্ণব পদাবলীর মূলরস শৃঙ্গার মধুর রস আর শাক্ত পদাবলীর মূলরস বাৎসল্য রস ।

১২. রামপ্রসাদ সেনের জন্ম ও মৃত্যু-সন কত ?

উ: আনুমানিক ১৭২০-২১ খ্রিস্টাব্দে হালিশহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন।

১৩. রামপ্রসাদ সেনের পদসংখ্যা কত ?

উ: পদসংখ্যা : প্রথমে একশ। এখন তা বেড়ে তিনশ।

১৪. রামপ্রসাদ সেনের আবির্ভাব কাল কত ?

উঃ দীনেশচন্দ্র সেনের বক্তব্য তাঁর জন্ম ১৭১৮-২৩ সালের মধ্যে। ক্ষেত্র গুপ্তের মতে তাঁর জন্ম ১৭২০ থেকে ১৭২১-এর মধ্যে। তাই বলা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তাঁর জন্ম। আর কবি মারা যায় ১৭৮১ সালে। অর্থাৎ বলা যায়অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তার জন্ম এবং দ্বিতীয়ার্ধে মৃত্যু হয়। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি।

১৫. রামপ্রসাদ সেনের পরিচয় দাও।

উ: কবির জন্ম অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চব্বিশ পরগনার হালিশহরে কুমারহট্ট গ্রামে। কবির পিতার নাম রাম সেন। কবি পিতার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। কবির নিজের দুই পুত্র ও দুই কন্যা (রাম দুলাল, রাম মোহন, পরমেশ্বরী, জগদীশ্বরী)। হালিশহরের গঙ্গার ধারে কবির পৈতৃক ভিটা। এখন ওখানে কবির সাধন ক্ষেত্র বর্তমান। কবি মারা যায় অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে।

১৭. রামপ্রসাদ সেনের আবির্ভাব কিভাবে হয়?

উঃ কবি কলকাতায় জমিদারের সেরেস্তায় মুহুরীর কাজ করার সময় খাতাতে ভাবাবেশে কবিতা বা পদ রচনা করেন- .

আমার দে মা এবার তবিলদারি।

নেমক হারামি নই মা আমি শঙ্করী।

যা দেশে জমিদারবাবু মাসিক বৃত্তি দিয়ে সাধন ভঞ্জনের ব্যবস্থা করে দেন।

১৮. রামপ্রসাদ সেন কার দ্বারা পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন ?

উ: কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন তিনি।

১৯. রামপ্রসাদ সেনের রচনাবলী উল্লেখ করো।

উ: কবি প্রচুর শাক্ত পদাবলী রচনা করেন। বাংলা সাহিত্যে এই পদ রচনা করার জন্য তিনি খ্যাতির শীর্ষে আরোহন করেন। কিন্তু এছাড়া কবি দুটি কাব্য রচনা করেন। যথা১. বিদ্যাসুন্দর/কালীকীর্তন, ২. কৃষ্ণকীর্তন।

২০. রামপ্রসাদ সেন কী কী উপাধি লাভ করেন ?

উ: বিদ্যাসুন্দর' বা কালীকীর্তন' রচনা করার জন্যে 'কবিরঞ্জন' উপাধি লাভ করেন। আর এই উপাধি দেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। কাব্যটি আমাদের কাছে কবিরঞ্জন বিদ্যাসুন্দর' নামে বেশি পরিচিত।

২১. রামপ্রসাদ সেনের কবিত্ব শক্তির বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ কর।

উ: ১. ভাবতন্ময় ও আত্মমগ্ন কবি। ২. তিনি সহজ সরল ভাবের কবি। ৩. শিল্পী সচেতন কবি ছিলেন না। তাঁর চিত্রকল্প একান্ত গ্রাম্য। ৪. তাঁর পদের বাণী অন্তোৎসারিত। ৫. তাঁর পদাবলীতে ফার্সি ও আইন আদালত সংক্রান্ত শব্দ প্রচুর পাওয়া যায়।

২২. রামপ্রসাদ সেনের কাব্যের কটি স্তর ও কী কী ?

উঃ চারটি স্তর। যথা- (ক) উমা বিষয়ক : ১. আগমনী ২. বিজয়া (খ) সাধন বিষয়ক (গ) দেবীর বিরাট স্বরূপ বিষয়ক (ঘ) তত্ত্বদর্শন ও নীতি বিষয়ক ।

২৩. রামপ্রসাদের পূর্বপুরুষ কোন বংশোদ্ভূত ছিলেন ?

উ: রামপ্রসাদের পূর্বপুরুষ বৈদ্য বংশোদ্ভূত ছিলেন।

২৪. রামপ্রসাদের গানের যে সাদামাটা সুর তা কী নামে প্রচলিত ?

উ: রামপ্রসাদের গানের যে সাদামাটা সুর তা 'প্রসাদী সুর' নামে প্রচলিত।

২৫. কবির গানে মুগ্ধ হয়ে কৃষ্ণচন্দ্র কী করতেন ?

উ: মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কবির গান শোনার জন্য কবির গ্রামের নিকটে নিজের কাছারিবাড়িতে অবস্থান করতেন।

২৬. রামপ্রসাদের মৃত্যু কোথায় হয়?

উ: সাধক কবি শ্যামাপূজার বিসর্জনের সায়াহ্নে ভাগীরতী তীরে সজ্ঞানে দেহত্যাগ করেন।

২৭. শাক্ত সাহিত্যে আর কোন কবিকে রামপ্রসাদ নামে চেনা যায়?

উ: পূর্ববঙ্গে দ্বিজ রামপ্রসাদ বলে অন্য এক কবি ও সাধক ছিলেন।

২৮. কমলাকান্তের জন্মস্থান কোথায় ?

উ: বর্ধমানের (কাটোয়াতে) কালনা।

২৯. কমলাকান্তের পদসংখ্যা কত?

উঃ প্রায় তিনশ।

৩০. কমলাকান্তের লিখিত গ্রন্থটি কী ?

উ: সাধকরঞ্জন।

৩১. কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের আবির্ভাব কাল কত ?

উ: কবির জন্ম মৃত্যু সন সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে কবির জন্ম। কবি শাক্ত পদ রচনা করেন উনবিংশ শতাব্দীতে। তাই বলা যায় তাঁর পদ রচনা কাল উনবিংশ শতাব্দী। অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীর কবি। তিনি ৫০ বছর জীবিত ছিলেন।

৩২. কমলাকান্তের পরিচয় দাও।

উ: কবির পৈতৃক নিবাস বর্ধমান জেলার কালনা গ্রামে। কবি অল্প বয়সে বিদ্যাশিক্ষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি টোলে যান। তাঁর কবি প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যে সন্তুষ্ট হয়ে বর্ধমানরাজ তেজশচন্দ্র তাঁকে গুরুপদে বরণ করে নেন।

৩৩. কমলাকান্ত ভট্টাচার্য কার কাছ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন?

উ: বর্ধমান রাজ তেজশচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন তিনি। তাঁর পাণ্ডিত্যে সন্তুষ্ট হবে তাঁকে গুরুপদে বরণ করে নেন।

৩৪. কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের রচনাগুলো কী?

উ: মূলত শাক্ত পদ রচনার জন্য তাঁর খ্যাতি। প্রায় ৩০০-এর বেশি পদ তিনি রচনা করেন। কিন্তু এছাড়া তিনি আর একটি গ্রন্থ লেখেন- "সাধকরঞ্জন"।

৩৫. কমলাকান্ত কী উপাধি লাভ করেছেন?

উ: কমলাকান্তের প্রকৃত পদবী হল- বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু 'ভট্টাচার্য' পদবী হিসাবে ব্যবহার করতেন। আসলে তিনি সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন। উচ্চ সংস্কৃত শিক্ষার জন্য তিনি টোলে যান। সেখান থেকে কবি এই উপাধি পায়। তাই বলা যায় 'ভট্টাচার্য' তাঁর উপাধি, পদবী নয়। তাঁর প্রকৃত পদবী হল 'বন্দ্যোপাধ্যায়'

৩৬. কমলাকান্তের কবিত্ব শক্তির বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দাও।

উ: ১. তিনি ভাব তন্ময় কবি ছিলেন না, তিনি শিল্পী সচেতন কবি। ২. তাঁর পদ ছন্দ অলংকারের সঙ্গে ছিল পরিমার্জিত ধৈর্য। ৩. আবেগ ভক্তি ও মণ্ডন নৈপুণ্য তাঁর পদের আর এক বৈশিষ্ট্য । ৪. তাঁর পদের বাণী অন্তোৎসারিত নয়। ৫. তাঁর পদের ভাষা মার্জিত ও পদের বাধুনী দৃঢ় ।

৩৭. কমলাকান্তের প্রথম জীবনের রচনা কী ?

উ: প্রথম জীবনে কমলাকান্তের 'সাধকরঞ্জন' নামে একখানি তন্ত্রসাধনার গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

৩৮. কমলাকান্তের প্রামাণিক পদসংগ্রহ কোথা থেকে প্রকাশিত হয় ?

উঃ লোকান্তর প্রাপ্তির পর বর্ধমান রাজবাটী থেকে তাঁর প্রামাণিক পদসংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে।

৩৯. কমলাকান্ত বাল্যকালে কোথায় প্রতিপালিত হয়েছেন?

উ: বাল্যকালে পিতৃবিয়োগ হলে চান্না গ্রামে মাতুলালয়ে প্রতিপালিত হন।

৪০. কমলাকান্ত কোথায় সভা-পণ্ডিত করেছিলেন?

উঃ বর্ধমান রাজের রাজসভায় তিনি সভা-পণ্ডিত করেছিলেন।

৪১. কবি কমলাকান্ত কাকে সৎ মা ভাবতেন?

উ: শ্যামা ভক্ত হওয়ায় কবি গঙ্গাকে সৎ মা ভাবতেন।

৪২. রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তের পার্থক্য কী ?

(১) রামপ্রসাদ ভাব তন্ময় ও আত্মমগ্ন কবি। কিন্তু কমলাকান্ত শিল্পী সচেতন কবি। তাঁর পদে যথেষ্ট পরিমার্জনশীল ধৈর্য লক্ষ্য করা যায়।

(২) রাম প্রসাদের ভাষা সহজ, সরল, চিত্রকল্প একান্ত গ্রাম্য। কমলাকান্তের পদ অপেক্ষাকৃত দীপ্ত ।

(৩) রামপ্রসাদের বাণী অন্তোৎসারিত। কিন্তু কমলাকান্তের পদ আন্তরিকতায় অগভীর।

(৪) রামপ্রসাদ ভক্তের আকুতি পর্যায়ের পদ রচনায় শ্রেষ্ঠ। কিন্তু আগমনী-বিজয়া পদে কমলাকান্ত শ্রেষ্ঠ ।