-->

নীলদর্পণ নাটকের নবীনমাধব চরিত্র // নায়ক বিচার

নায়ক-চরিত্র বা নায়িকা চরিত্র উপন্যাস ও নাটকের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত থেকে কাহিনীর গতিপ্রবাহকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে থাকেন। তাঁকে আশ্রয় করে ঘটনাসমূহ আবর্তিত হয় এবং অন্যান্য চরিত্রেরা তাঁদের মনোভাব ও আচরণের দ্বারা মূল চরিত্রকে উজ্জ্বল করে তোলে। মূল কাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক অপ্রধান কাহিনী এবং অপ্রধান চরিত্র থাকতে পারে। তারা স্বতন্ত্র রূপে বিকশিত হয়ে পরিণামে মূল ধারাকে ফুটিয়ে তোলে। নায়ক-চরিত্রে বলিষ্ঠতা ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশহেতু মনোবল ও আত্মপ্রত্যয় অত্যাবশ্যক।

দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণনাটকে নবীনমাধব বসু-কে নায়ক হিসাবে এঁকেছেন। তাঁর চরিত্রে বহুবিধ গুণের সমাবেশ। প্রকৃতপক্ষেই তিনি স্বরপুর-বৃকোদর’—অত্যাচারিত প্রজাবর্গের দুর্গতিতে তিনি যেমন তাদের পক্ষ নিয়ে গভীর সমবেদনার সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন, তেমনি নীলকরদের বিরুদ্ধেই করেছেন সংগ্রাম। যখন গোলোক বসু নবীনমাধবকে বলেছেন,

সাহেবের সঙ্গে বিবাদ তো সম্ভবে না

তখন দৃঢ়চেতা নবীনমাধব উত্তর দেন,

কিন্তু আমার মানস একবার মোকদ্দমা করা।

কিন্তু এর তাৎপর্য ও পরিণাম তিনি জানেন, কারণ পক্ষপাতদুষ্ট বিচার-ব্যবস্থায় তাঁকে আরও অত্যাচারের মধ্যে পড়তে হবে। গ্রামের দরিদ্র রাইয়তেরা তাঁর ওপর নির্ভরশীল। কেবল সাধুচরণের পরিবারই নয়, সাধারণ চাষীও মিথ্যা বকেয়ার অপরাধে ধৃত হয়ে তাঁকে আবেদন করেছে, বড়বাবু মোর ছেলে দুটোরে খাতি দিও গো, মোরে মাটেতে ধরে আনলে তাদের দ্যাক্‌তি পালাম না। আদালত থেকে সমন লাভের পর পিতা গোলোকচন্দ্রকে ইন্দ্রাবাদ যেতে হবেএই সংবাদে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পুত্র নবীনমাধব গ্রাম ত্যাগের চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু অচিরেই তিনি এই ভেবে সিদ্ধান্ত বদল করেন যে, এর ফলে দুর্গত প্রজাদের উপর অবিচার করা হবে। অতএব পরধর্মের পরমতার কথা চিন্তা করে তিনি মত বদল করেন।

নবীনমাধব চরিত্রের বলিষ্ঠ মনোভাব ও নির্ভীকতা বেগুনবেড়ের কুঠিতে অন্তরীণ সাধুচরণ ও রাইচরণের উপর নীলকর উডের অত্যাচারকালে তাদের মুক্তি কল্পে নবীনমাধবের সাহসী উপস্থিতি এবং তোরাপের সাহায্যে রোগের কামরা থেকে ক্ষেত্রমণিকে উদ্ধার করার ঘটনাদ্বয়ে প্রকাশ পেয়েছে। বেগুনবেড়ের কুঠিতে নবীনমাধব উপস্থিত হয়ে সাধুচরণ ও রাইচরণের মুক্তির জন্য অনুরোধ করলে তাঁকেও লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছে। দেওয়ান গোপীনাথও তাঁর অপমান সহ্য করতে না পেরে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পরামর্শ দিয়েছে। তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় গর্ভাঙ্কে ধর্ষিতা ক্ষেত্রমণির উদ্ধার দৃশ্যেও নবীনমাধবের চরিত্রের বলিষ্ঠতা ও ঔদার্য প্রকাশিত। পঞ্চম অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে সাধুচরণের সংলাপে আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে নবীনমাধবের ভয়শূন্য আচরণের পরিচয় মেলে। উডের অপমানজনক ব্যবহারের প্রতিবাদে নবীনমাধব উডকে পদাঘাত করেন (যদিও এর ফলে তাঁকে চরম নির্যাতন ভোগ করতে হয় এবং এতেই শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু ঘটে)। অর্থাৎ নায়ক সুলভ মনোবল, সঙ্কল্প-সাধনের দৃঢ়তা, দুর্গতদের প্রতি মায়া ও সহানুভূতি নবীনমাধবের চরিত্রে যে উপস্থিত, তালক্ষ্য করা যায়।

কিন্তু তদ্‌সত্ত্বেও নীলদর্পণে নবীনমাধব নায়ক-মহিমা প্রাপ্ত হননি। কারণ, নাটকটিতে দুটি কাহিনী সমান্তরাল ধারায় প্রসারিত হয়ে কাহিনী-অংশকে দ্বিধাবিভক্ত করেছেনবীনমাধবের নৈতিক ঔৎকর্ষ ও কর্মপ্রবাহ দুটি অংশের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করলেও তাঁকে কেন্দ্র করে দুটি ধারা মিলিত হয়নি।

তাছাড়া, বলিষ্ঠ-চরিত্রের পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও অসম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে তিনি নিতান্ত অসহায়তা দেখিয়েছেন। নাটকের কার্যধারায় নায়কের যে নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, তাতাঁর মধ্যে দেখা যায়না। সাধুচরণ ও রাইচরণের মুক্তির অনুরোধ করতে গিয়ে তিনি নীলকর সাহেবদের কাছে অপমানিত হন। এই ঘটনায় তিনি মর্মপীড়া অনুভব করলেও ক্ষমতাগর্বী নিপীড়নকারীর বিরুদ্ধে তিনি কোনো প্রতিবাদ করতে পারেন নি (কেবলমাত্র ধর্ষিতা ক্ষেত্রমণির উদ্ধার দৃশ্যেই নবীনমাধবের বলিষ্ঠ মনোবলের প্রকাশ দেখা যায়); কিন্তু সেক্ষেত্রে তোরাপ রোগসাহেবকে উপযুক্ত প্রত্যুত্তর দেয়। নবীনমাধবের নৈতিক মনোভাবও প্রবল ধর্মসংস্কারের পরিচায়ক, যানায়কের মানস-বিরোধী,

ওরা নির্দয় বল্যে আমাদের নির্দয় হওয়া উচিত নয়।

দুর্গত প্রজা ও স্বীয় পরিবারউভয় পক্ষেই নবীনমাধব নীলকর সাহেবদের কাছে আবেদন-নিবেদন করে তাঁদের করুণা ভিক্ষা করেছেন। নীলকরদেরকে হৃদয়হীন জেনেও অসহায়ের মত তিনি তাঁদের কাছে গেছেন, শেষপর্যন্ত নিজের পবিত্র রক্তধারায় নীলকরদের অত্যাচারাগ্নিনিভিয়েছেন। কিন্তু এতে নবীনমাধবের চারিত্রিক দুর্বলতাই প্রকটিত, যানায়কোচিত নয়।

নীলদর্পণনাটকে প্রকৃত কোন সংঘাতের কোন অবকাশ গড়ে ওঠেনি। অর্থলিপ্সু নীলকরেরা শাসকদের মদতে অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়ে গেছেন অসহায় নীলচাষীদের উপর। তাদের জন্য ব্যথা অনুভব করেছেন প্রজাপালক ও প্রজাহিতৈষী নবীনমাধব। দীনবন্ধু যদি তৎকালীন অসন্তোষের পটভূমিতে নবীনমাধবের চরিত্র ও কর্মে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নেতৃত্বভার দিতেন, তবে প্রকৃত ও যথার্থ সংঘাত সৃষ্টি হত। সাধুচরণ ও তোরাপের সাহায্যে একটি প্রতিরোধ আন্দোলনও গড়ে তোলা যেত । অথচ কাহিনীতে উৎপীড়নকে মেনে নেওয়ায় কোনো জটিল আবর্ত সৃষ্টি হতে পারেনি। নবীনমাধবের মধ্যে গভীর বেদনা ও মানসিক ক্ষোভ জাগিলেও কোনো অন্তর্দ্বন্দ্ব-সৃষ্টির সুযোগ আসেনি। সংঘাত ও জটিলতার স্তরে চরিত্রের যে বিকাশ এখানে প্রত্যাশিত ছিল, তাও সার্থক হয়নি।

আসলে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র এখানে নীলকর সাহেবদের নিপীড়ন ও অত্যাচারের রূপটিকে উদ্ঘাটিত করতে চেয়েছিলেন বলে নায়ক চরিত্রের প্রতি যথোচিত দৃষ্টি দেননি। আখ্যানের দুটি ধারায় অমানবিক উৎপীড়ন অবতীর্ণ হয়ে এক মর্মন্তুদ পরিণাম রচনা করেছে ; আর নাট্যকার এই পরিণামের দিকে মনোনিবেশ করায় নায়ক চরিত্রের দুর্বলতা হেতু অপূর্ণতার দিকটি অবহেলিত হয়েছে। যদিও নবীনমাধবের চরিত্রে নায়ক-সুলভ সকল গুণই বর্তমান ছিল। ক্ষেত্রমণির মৃত্যুশয্যায় দাঁড়িয়ে সাধুচরণ নবীনমাধব সম্পর্কে যাবলেছিলেন, তামানবতার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হলেও কখনোই নায়কের মহিমাব্যঞ্জক বলা চলে না, গ্রামের ভিতর একটা ছাড়িয়া দশটা নীলকুঠি স্থাপিত হয় তাও সহ্য করিতে পারি, কিন্তু এক মুহূর্তের নিমিত্তেও প্রজাপালক বড়বাবুর বিরহ সহ্য করিতে পারি না।