-->

ঘরে বাইরে উপন্যাসের বিমলা চরিত্র


ঘরে বাইরে উপন্যাসের বিমলা চরিত্র

বিমলা চরিত্র

ঘরে বাইরেউপন্যাসের সবচেয়ে বাস্তবধর্মী চরিত্র সম্ভবত বিমলা। নারী মন যে সমস্ত বিচিত্র অনুভূতির জন্ম হয় বিমলা চরিত্রের ভেতর রবীন্দ্রনাথ তার পূর্ণ রূপদান করেছেন। বড়লোক স্বামীর ভালোবাসা বিয়ের দিন থেকেই বিমলা লাভ করে। স্বামী নিখিলেশকে বিমলা পুজো করেছে দেবতার মতো। এরপর সন্দ্বীপের আগমন। সন্দীপের প্রতি আকর্ষণ। তার স্তুতিতে মগ্ন হওয়া। বিমলা জায়েদের প্রতি ঈর্ষার মনোভাব, অমূল্যকে নিয়ে মাতৃত্বের জাগরণ, সন্দীপের মোহ কাটিয়ে ওঠা, অনুতাপে দগ্ধ হওয়া বিষয়গুলির ভেতর দিয়ে বিমলার অন্তর্দ্বন্দ্ব তাকে বাস্তবধর্মীতা দিয়েছে। ঘরে বাইরের প্রধান চরিত্র নিখিলেশ-সন্দীপ-বিমলার মধ্যে বিমলাই সবচেয়ে বাস্তব। সবচেয়ে জীবন্ত। রবীন্দ্রনাথ বিমলাকে রেখেছেন উপন্যাসের কাহিনিবৃত্তের মাঝে। বিমলাকে কেন্দ্র করেই, সন্দীপ-নিখিলেশ আবর্তিত হয়েছে।

গ্রামের মেয়ে বিমলা। সে তেমন শিক্ষিত নয়। জমিদার বাড়িতে বউ হয়ে এল সে। নিখিলেশের প্রতি ছিল তার গভীর টান। ভক্তি। ভোরে উঠে সে স্বামীর পায়ের ধুলো নিতো। তখন মনে হতো সিঁথির সিঁদুরটি যেন শুকতারার মতো জ্বলে উঠলো। পতিভক্তির দীক্ষা সে নিয়েছিল মায়ের কাছ থেকে। স্বামীকে ভালোবাসার মধ্যে কোন ফাঁকি ছিল না তার। নিখিলেশের ছবিতে রোজ ফুল দিত। স্বামীকে ভাবত দেবতা। তার ভালোবাসাকে এভাবেই সার্থক করতে চেয়েছে বিমলা।

নিখিলেশ যে সময় কলকাতাতে এম.এ পড়ার জন্য থাকতো তখন প্রতিদিন চিঠি লিখত বিমলাকে। বিমলা সেগুলি চন্দন কাঠের বাক্সের ভেতর সাজিয়ে রাখতো। বাগান থেকে ফুল তুলে সেগুলি রাখত ঢেকে। বিমলার মনে হতো ঐ চিঠির অক্ষরগুলি যেন স্নিগ্ধ হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। স্বামী তার রাজপুত্র। সে তার রাণী। এতেই বিমলার আনন্দ।

বিমলার মধ্যে সহনশীলতা ছিল। জায়েরা তাকে টিটকিরি করতো। বিমলা নিখিলেশকে কথা দিয়েছিল কোন কারণে জায়েদের কথায় প্রতিবাদ করবে না। সে কথা সে রেখেছে।

নিখিলেশ, চেয়েছে বিমলাকে নিয়ে প্রেম সম্পর্কে তার একটা বিশ্বাস যাচাই করতে। চিরাচরিত দাম্পত্য প্রেমের সংস্কারে স্ত্রী তো স্বামীকে ভালোবাসেই। বাইরের জীবনে প্রত্যেকের সাথে মিশেও যদি স্ত্রী স্বামীকে একান্ত করে পায়, তবেই সেটা ঠিক পাওয়া। নিখিলেশ তাই বিমলাকে কর্তব্যের ছোটো জায়গা থেকে মুক্ত করে দিয়েছিল। বিয়ের পর বিমলার জন্য শিক্ষিকা রাখা হয়েছিল।

সন্দীপ তার বন্ধু নিখিলেশের বাড়ি এলো। এলো স্বদেশী প্রচারে। বিমলার অভিমান ছিল সতীত্ব নিয়ে। সন্দীপের সান্নিধ্যে বিমলার বিহ্বলতা কারোরই দৃষ্টি এড়াবার নয়। বিমলাও মুগ্ধ হয়েছে সন্দীপের স্তাবকতায়। বিমলার চরিত্রের মধ্যেও যে দুর্বলতা আছে এটা সে জানতো না ।

বিমলা সন্দীপকে খাওয়াতে চেয়েছে নিজে উপস্থিত থেকে। নিখিলেশ বহুবার বন্ধুর সামনে বিমলাকে বের হবার জন্য অনুরোধ করেছে। বিমলা তা রক্ষা করেনি নারীত্বের লজ্জায়। সন্দীপের সামনে নিজেকে সজ্জিত করে বের করতে সে কুণ্ঠিত হয়নি।

প্রথমবার সন্দীপের সামনে বিমলা লজ্জা আর কুণ্ঠার কারণে নিজেকে ধিক্কার দেয়। সন্দীপের সামনে বের হতে একটু সাজসজ্জাও যে না করেছে তা নয়। বিমলার মেজো জা-এর তা চোখে ঠেকেছে। বিমলারও কিছুটা সঙ্কোচ হয়েছে। বাইরের লোকের কাছে আটপৌরে সাজে বের হলে নিখিলেশ অপছন্দ করতে পারে। শেষে এমন একটা যুক্তি দেখিয়ে বিমলা নিজের সাজকে খর্বিত করেনি। প্রথম দেখা থেকেই সন্দীপের প্রতি বিমলার মনোভাব কেমন জানি হয়ে যায়। নিজে স্বীকার করে যে সন্দীপের যে সাজ ভালো লাগেবিমলা সেই সাজ আজ ধারণ করবে। মেজো জা এতে তাকে তিরস্কার করে। বিমলা তা গ্রাহ্য করে না।

বিমলা দুর্বার। নিখিলেশের কথায় বিমলা ন্যায়পরতার দায়িত্ব এড়িয়ে অন্যায়ের দ্বারা সে তাড়াতাড়ি ফল পেতে চায়। তার ধৈর্য নেই। পুরুষের ভেতর সে দেখতে চায়দুর্দান্ত, রাগী, অন্যায়কারীকেও। যা কিছু উৎকট, যা কিছু দুর্বার এই সমস্ত ব্যাপারে বিমলার আকর্ষণ বেশি। এই কারণে সন্দীপের আকর্ষণ সে রোধ করেনি। নিজেকে ছারখার করে দেবার ভেতরও একটা রুদ্র মাধুর্যকে সে লক্ষ্য করেছে। বিমলা চায়নি নিজেকে ধ্বংসের নেশা থেকে রুখতে। সন্দীপের চালাকি সে প্রথমে ধরতে পারেনি। সহজ পথে জীবনকে চালনা করার বাইরে অন্য এক জীবনের মাদকতা রয়েছে, তাই তাকে লুব্ধ করেছে। সন্দীপ তাকে রাণী বলে ডাকতো। সেও সেই ডাকে নিজেকে সংযত রাখতে পারে না।

বিমলা ধীরে ধীরে সন্দীপের কাছে ধরা দেয়। স্বামীর ছবির পাশে সন্দীপের একটা ছবি একই ফটোস্ট্যাণ্ডে ছিল। সন্দীপের ছবিটি গহনার বাক্সের মধ্যে রেখেছে সে। ঘরের দরজা বন্ধ করে সে সন্দীপের ছবি দেখেছে। এক এক বার মনে হয়েছে ছবিটাকে মন থেকে সরিয়ে ফেলবে। কিন্তু মনের জোর তার ছিল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার সন্দীপের ছবিকেই রক্ষা করেছে বিমলা। নিখিলেশের প্রতি তার ভালোবাসাও মিথ্যে নয়। তবু সন্দীপের প্রতি তার আকর্ষণ। এতে ব্যথা পেয়েছে বিমলা। অন্তর্দ্বন্দ্ব হয়েছে।

ধীরে ধীরে বিমলা লজ্জা সংকোচ দূর করেছে। সন্দীপের মধুর কথায় বিমলা আস্থা স্থাপন করেছে। নিজেকে শ্বশুরবাড়ির আর পাঁচজন নারীর মতো দেখেনি। সন্দীপ বুঝিয়েছে

দ্বিধা করাটা মেয়েদের প্রকৃতি নয়। তার ডাইনে বাঁয়ে নেই, তার একমাত্র আছে সামনে।

সন্দীপ বলেছে

দেশের মেয়েরা যখন জাগবে তখন তারা পুরুষের চেয়ে ঢের বেশি স্পষ্ট করে বলবে ‘আমরা চাই’—”

বিমলাকে সন্দীপের এই কথার মোহ উদ্দাম করেছে। মেজো জায়ের আচরণে বিমলার মনে তুলনাবোধ জন্মায়। সেই সময় সন্দীপের কথায় জোর পায় বিমলা ৷ বোঝে যে লোকলজ্জাবশত মেয়েদের পিছিয়ে থাকার কাল আর নেই। আমি চাইকথাটাকেই সঙ্কোচহীন ভাবে অন্তরে বাইরে সমস্ত শক্তি দিয়ে বলতে পারাই হচ্ছে পূর্ণ প্রকাশ । সে আচ্ছন্ন হয়েছে উদ্দামতার নেশায়। এমনভাবেই বিমলা নিজেকে উদ্দীপ্ত বোধ করে। নারী প্রকৃতির আদিম সংস্কারে সে সেইসময় মেঝের উপর উপুড় হয়ে কাঁদতে শুরু করে। নতুন কিছু করার শক্তি সে হারায়।

বিমলার মধ্যে ছোটো কিছু ত্রুটি ছিল। মাঝে মধ্যে সে অভিযোগ প্রবণ হয়ে উঠেছে। জায়ের বিপক্ষে স্বামীর কাছে নালিশ করেছে। ফল হয়নি। অনুতপ্ত হয়েছে এই ভেবে যে স্বামীর কাছে ছোটো হয়ে যেতে হল।

বিমলা কিছুটা ঈর্ষা প্রবণও। শাশুড়ি মারা যাবার পর স্বামী যে সময় তাকে নিয়ে কলকাতা আসতে চাইলো, বিধবা জায়েদের ওপর সংসার তুলে দিয়ে সে আসতে চায়নি। স্বামীর ভালো যারা চায় না তারাই জাঁকিয়ে রাজত্ব করবে বিমলা তা চায়নি। শ্বশুরের ভিটের প্রতি বিমলার মমত্বও ছিল। স্বামীর প্রতি ভালোবাসার জন্যই মেজো জায়ের প্রতি তার কিছুটা ঈর্ষাও ছিল।

সাধারণ থেকে অসাধারণ নারীত্বে পৌঁছোবার চেষ্টা বিমলার ছিল না। আবার সন্দীপের সান্নিধ্যে এসে বিমলার পরিবর্তনও হয়েছে। যে বিমলা রোজ সকালে স্নান করে ফুল তুলে স্বামীর ছবির সামনে ফুলগুলি রেখে প্রণাম করতো,  সেই স্বামীর ছবির সামনে ফুল দিতে চায়নি। ছবির সামনের ফুল অনেকদিন ধরে শুকিয়েছে। ফুলগুলি সরিয়ে নেয়নি।

বিবেচনা শক্তি বিমলার কম ছিল। কারণ তা না হলে সন্দীপের প্রতি সে মোহগ্রস্ত হবে কেন? মেজো জা সন্দীপের হাত থেকে বিমলাকে বার বার বাঁচাতে চেয়েছে। বলেছে স্বামীকে খুশি করতে বিমলার উচিত দেশি জিনিসের প্রতি বিমলার উৎসাহ হওয়া। বিমলা তা শোনেনি। উল্টোদিকে সন্দীপের মধ্যেই টান অনুভব করেছে। তা করেছে স্বামীর ভালোবাসাকে না বুঝে। সন্দীপের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে সে ব্যগ্র হয়েছে। সন্দীপের পায়ে পড়ে কেঁদে বলেছে

রাজা আমার, দেবতা আমার, তুমি আমার মধ্যে যে কী দেখেছ তা জানি নে, কিন্তু আমি আমার হৃৎপদ্মের উপরে তোমার বিশ্বরূপ দেখলুম।

এ কি কোন বিচার প্রবণ নারী করতে পারে? এ তো মোহগ্রস্ত নারীর কথা । বিমলা নিজেকে গৌরবান্বিত ভাবতে থাকে। তার জীবনে যেন একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। সে শুধু ঘরের মধ্যে আবদ্ধ নয়। বিমলা ভাবে

এত দিন আমি ছিলুম গ্রামের একটা ছোটো নদী; তখন ছিল আমার এক ছন্দ, এক ভাষা কিন্তু কখন একদিন কোনো খবর না দিয়ে সমুদ্রের বাণ ডেকে এলো; আমার বুক ফুলে উঠল, আমার কুল ছাপিয়ে গেল, সমুদ্রের ডমরুর তালে তালে আমার স্রোতের কলতান আপনি বেজে বেজে উঠতে লাগল। আমি আপনার রক্তের ভিতরকার সেই ধ্বনির ঠিক ঠিক অর্থটা তো কিছুই বুঝতে পারলুম না। সে আমি কোথায় গেল? হঠাৎ আমার মধ্যে রূপের ঢেউ কোথা থেকে এমন করে ফেনিয়ে এলো?”

এই অনুভবের মধ্যে সূক্ষ্ম বিবেচনা নেই। স্বামীর ভালোবাসার প্রেক্ষিতটি বিমলার মনে কোন কাজ করেনি। বিমলা স্বামীর কাছ থেকে কাজ আদায়ের জন্য নিজেকে সজ্জিত করেছে। সন্দীপের ইচ্ছায় নিখিলেশের হাট থেকে বিলাতি কাপড় বিক্রি বন্ধ করতে বিমলা পুরনো দিনের মতো ঘাড়ের ওপর দিকে চুলগুলি তুলে খোঁপা বেঁধেছে। নিখিলেশ যেমন পছন্দ করে। নিখিলেশ এই চাতুরি ধরে ফেলেছে।

বিমলা নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলেছিল। দেশ প্রসঙ্গে সে নিখিলেশকে যে কথা বলে তা সন্দীপেরই শেখানো। সন্দীপের চালাকিতে বিমলা মুগ্ধ হয়েছে। সন্দীপের চাওয়া টাকা জোগাড় করতে সে চুরি পর্যন্ত করেছে। কিন্তু সে তো এমন ছিল না। সে যেন নেশায় আচ্ছন্ন হয়েছে।

শেষে অনুতাপে দগ্ধ হয়ে বিমলা মেজোরাণীর পদধূলি নিয়ে মিথ্যা বলেছে। বলেছে সেদিন তার জন্মদিন। তাই পদধূলি নিতে এসেছে। মেজো জায়ের আশীর্বাদ চেয়েছে। সে যেন তাদের দুঃখের কারণ না হয়। নিজে যে দুঃখ পেয়েছে, সে তার নিজের জন্যই তৈরি, এই ধারণা বিমলার হয়েছে। এ আত্মপীড়ন ছাড়া কিছু নয়।

বিমলার মধ্যে নারীর মমতা ছিল। কোমলতা ছিল। অমূল্যর মুখে সন্দীপের কথার প্রতিধ্বনি শুনে বিমলা চমকে যায়। অমূল্য যখন রিভলবার দেখিয়ে সন্ত্রাসবাদের কথা শোনায় বিমলা বেদনায় কাতরে ওঠে। বিমলার ভাবতে কষ্ট হয় একজন মানুষকে বিনা দোষে মারা যায়। অমূল্যর পরিণতি ভেবে বিমলা ব্যথিত হয়েছে। জেগে উঠেছে মাতৃস্নেহ। অমূল্যর সামনে অমূল্যর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে বিমলা। সে লিখেছে

নারী হৃদয়ের যেখানে মায়ের আসন আমার সেইখানকার জানলাটি হঠাৎ এই একবার খুলে গিয়েছিল।

অমূল্যকে গয়না বেচতে কলকাতায় পাঠিয়ে সে উৎকণ্ঠায় থেকেছে। এ তার কোমল মনের পরিচয়। অমূল্যর প্রতি এই মায়া বিমলার সত্যবোধকে জাগাতে সাহায্য করে।

এই ভাবেই রবীন্দ্রনাথ বিমলা চরিত্রকে বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন অন্তর্দ্বন্দ্বময় নারী হিসেবে অঙ্কন করেছেন।



বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন