-->

ঘরে বাইরে উপন্যাসে নিখিলেশ চরিত্র

 

নিখিলেশ:

ঘরে বাইরে উপন্যাসে নিখিলেশ চরিত্র


‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের নিখিলেশ উচ্চশিক্ষিত, চরিত্রবাণ। নিখিলেশ ধনী, জমিদার। তার ভেতর পূর্বপুরুষের চরিত্রদোষ নেই। মদ ও মহিলার প্রতি আকর্ষণ নেই। নৈতিকতার একটা সুপ্ত অহংকার নিখিলেশের মধ্যে আছে। উচ্চবিত্ত সমাজ যখন শ্রেণিস্বার্থ আগলাতে ব্যস্ত, নিখিলেশ স্বার্থপর হয়নি।

নিখিলেশ তার স্ত্রী বিমলার যথাযথ ভালোবাসা পেতে চেয়েছে। সে স্ত্রীর কাছ থেকে পুজো চায়নি। বিমলা নিখিলেশকে বলেছে—“প্রিয়তম, তুমি আমার পূজা চাও নি সে তোমারই যোগ্য”

নিখিলেশ চায়নি বিমলাকে ঘরে বন্দি রাখতে। বাইরের কাজকর্মের জগতে স্বামী এবং স্ত্রী একে অন্যকে জানবে, একে অন্যকে বুঝবে নিখিলেশ তাই ভেবেছে। বিমলাকে তাই নিখিলেশ লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছে। বাইরের সত্যের ভেতরে নিখিলেশকে চিনুক বিমলাএই ছিল নিখিলেশের ইচ্ছা। সাহেবদের দোকান থেকে নিখিলেশ পোষাক আনতো বিমলার জন্য। মেমসাহেব রেখে পড়িয়েছে বিমলাকে ।

বাইরে বেরিয়ে বিরাট পৃথিবীর পরিচয় বিমলা লাভ করুক, স্বামীকে বিচার করতে শিখুকএই চেয়েছিল নিখিলেশ।

নিখিলেশ চায়নি নারীকে বন্দিনী করে রাখতে। নারী ও পুরুষের পরস্পরের প্রতি সমান অধিকার। তাই তাদের প্রেমের সম্বন্ধও সমান। নিখিলেশ চেয়েছে বিমলাকে বৃহৎ জগতে মুক্ত করে দিতে। নিখিলেশ এই পরীক্ষাটি করতে চেয়েছে। তার উক্তি—“আমি লোভী নই, প্রেমিক । সেই জন্যেই তালা-দেওয়া লোহার সিন্দুকের জিনিস চাই নাআমি তাকেই চেয়েছিলুম আপনি ধরা না দিলে যাকে কোনোমতেই ধরা যায় না। স্মৃতি সংহিতার পুথির কাগজের কাটা ফুলে আমি ঘর সাজাতে চায় নি; বিশ্বের মধ্যে জ্ঞানে শক্তিতে প্রেমে পূর্ণ বিকশিত বিমলাকে দেখবার বড় ইচ্ছে ছিল।নিখিলেশের বিশ্বাস ব্যক্তিস্বতন্ত্র্যতে। আর তারই জন্য নিজের স্ত্রীকে নিয়ে পরীক্ষায় মেতেছিল সে।

নিখিলেশ উদার। কারো দোষ সে ধরতে চায় না। বৌদিদের অনুরোধ রাখতে তৎপর । বৌদিরা বঞ্চিত, তাই ক্ষমার চোখে তাদের দেখতে চাইতো নিখিলেশ। তার বিশ্বাস বঞ্চিতদের ঈর্ষায় কিছু মনে করতে নেই। বিমলাকেও তাই শেখায় নিখিলেশ।

বিমলা সম্পর্কে নিখিলেশ উদারতাই দেখিয়েছে। তাকে বলেছেবিমলাকে ছুটি দিল সে। সে বিমলার হাতের কড়া হতে চায় না এও বলেছে।

যথার্থ দেশপ্রেম বলতে যা বোঝায় নিখিলেশের মধ্যে আমরা তা দেখেছি। কলেজে পড়ার সময়ই নিখিলেশ দেশের পক্ষে প্রয়োজনীয় জিনিস দেশেই তৈরি করবেন এমন ইচ্ছায় নানা কাজ শুরু করেছিল। অনেকগুলি খেজুর গাছ থেকে একটি নলের সাহায্যে রস এনে তার সাহায্যে চিনি তৈরির চেষ্টা করেছিল। সুফল এলেও তাতে যা টাকা খরচ হল তা চালানো মুশলিক হল। সমস্ত কাজেই টাকার অভাব বোঝা গেল। ব্যাঙ্ক খুলে টাকার ওপর সুদের হার বেশি দিল। লোকে টাকা জমাবার আগ্রহ দেখালো। কিন্তু তা চলল না।

নিখিলেশ দেশকে দেখেছে সত্যের দৃষ্টিতে। তার কথায় সে নরনারায়ণের উপাসক। মানুষের ভেতরেই তার ভগবানের সত্যিকারের প্রকাশ। দেশের মধ্যেও তাই। দেশকে ভালোবাসার বিষয়ে নিখিলেশ সত্যসন্ধানী। অধর্মকে সে ধর্ম বলে চালাতে চায়নি। তার যা কিছু মন্দ তা দেশকে দিতে চায় না।

দেশের ভেতর যারা নীচ, যারা পতিত, যারা গরীব তার কল্যাণধর্মে সে বিশ্বাস করে। সে জানে নীচ বা দরিদ্র মানুষের ভেতর কৌলীন্য বা মৌলিকতার গর্ববোধ রয়েছে। তারা সেই কারণেই ওপর মহলকে এড়িয়ে চলে। তাতেই কষ্ট নিখিলেশের। সে বোঝে ভারত শুধু ভদ্রলোকের ভারত নয়। নীচ লোক যত নামবে, ভারত তত নামবে। তারা যত মরছে, ভারত ততই মরবে।

নিখিলেশের সংযম ছিল স্বদেশিয়ানায়। অকারণ চাঞ্চল্য তার পছন্দ নয় ৷ নিখিলেশ দেশি ছুরিতে কাটতো দেশি পেনসিল। সে খাগড়ার কলমে লিখতো। সন্ধ্যার কালে লেখাপড়া করতো দেশি বাতি জ্বেলে । বসার ঘরে বিলিতি আসবাব রাখতো না। পেতলের ঘটিকে ফুলদানি করে ব্যবহার করতো। দেশি জিনিসের প্রতি ছিল তাঁর একান্ত দরদ। নিখিলেশের সুখ-সায়রের হাটে দেশি মিলের থেকে দেশি কাপড় দেশি সুতো আনিয়েছিল বিক্রীর জন্য। যারা বিলিতি সুতোর কারবার বা বিক্রি করে সংসার চালাতো, তাদের নিখিলেশ বারণ করতে পারে না। বিমলার কথায়ও না। দেশি জিনিস যাতে সবাই ক্রয় করে এমন ইচ্ছা তার ছিল । গবীর মানুষ সস্তায় বিলিতি সুতোই বেশি কেনে, সেখানে নিখিলেশ বাধা দেয় না। হাটে বিলিতি সুতো বিক্রির বিরুদ্ধে তাকে ক্ষ্যাপানো যায় না। নিখিলেশ জানে বেশি পয়সা দিয়ে দেশের লোকের সাধ্য নেই দেশি জিনিস কেনে। সেই কারণেই তাদের হাটে সমস্ত বিলিতি জিনিস বেচতে আসেতাদের সে নিষেধ করতে পারে না । নিখিলেশের দান ধ্যানের ফর্দ বিরাট। কেউ যদি তাঁতের কল তৈরি করবে বা ধান ভাঙাবার যন্ত্র তৈরি করবে জানে তাদের মুক্ত হস্তে দান করত নিখিলেশ।

সন্দীপ নিখিলেশের কাছে আসে দেশসেবার অজুহাত নিয়ে। তাকেও টাকা দেয় নিখিলেশ। সন্দীপের মতের সাথে নিখিলেশের মতের কোন মিল নেই। সংসার খরচের জন্য নিয়মিত টাকা মাসিক বরাদ্দ করে সন্দীপের। নিখিলেশ অন্তর্মুখী। মানস পরিভ্রমণেও নিঃসঙ্গ। তার চিন্তার মধ্যে জাতি বা দেশের চিন্তা নেই।

নিখিলেশ শান্ত উত্তেজনা বশে সে কোন কিছু করে বসে না। ভৃত্যদের কাজের ত্রুটিও সহ্য করে। বকাবকি তার স্বভাব নয়। মারধোর তার স্বভাব নয়। সে সহিষ্ণু। বিমলা মিস্‌ গিলবিকে পড়ানো থেকে ছাড়িয়ে দিতে চাইলে নিখিলেশ নীরব থাকে। বিমলা যা ইচ্ছে তাই বলে গেলেও প্রতিবাদ করে না নিখিলেশ ৷

নিখিলেশ জোর করতে জানে না। স্বাভাবিকভাবে সহজ উপায়ে যা পেতে পারে তা না জুটলেও জোর করে কেড়ে নিতে পারে না। বিমলাকে স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে সুযোগ দেয়। বিমলার আনুগত্য সে চায় না। বিমলা বাইরের জন্য অধীর হলে, নিখিলেশের প্রতি উদাসীন হলে, নিখিলেশ জোর করে তাকে ঘরে আটকে রাখতে চায়নি। কান্না দিয়ে বেঁধে রাখতে চায়নি। বলেছে— “ভালোবাসা যেখানে একেবারে মিথ্যা হয়ে গেছে সেখানে কান্না যেন সেই মিথ্যাকে বাঁচাতে না চায়।

যে-কোন ঘটনাকে স্বীকার করতে সে জানে। দুপুরে শোবার ঘরে বই আনতে গিয়ে নিজের ছবিটা দেখতে পেল। ছবিতে প্রতিদিন বিমলা স্নানের পর ফুল রেখে প্রণাম করত। সেদিন তার নিজের ছবিটা দেখে বিমলার কাছে তার মূল্য এখন কেমনতা সহজে যাচাই করে নিতে পারে নিখিলেশ। বিমলা এখন তাকে ফুল দেয় না। ছবির সামনে শুকনো কালো ফুল। সেগুলি সরিয়ে নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি বিমলা। এই সত্যকে নীরবে সহ্য করে নিখিলেশ।

নিখিলেশ আগেই বুঝেছিল সন্দীপ ধূর্ত । চতুরতা দিয়ে সন্দীপ তার দুর্বলতাকে ঢাকে। বিমলার কাছে নিখিলেশ সন্দীপের এই মোহ ও চাতুর্যের মুখোশ খুলে দেয়নি। কারণ বিমলা মনে করতে পারে সন্দীপকে নিয়ে নিখিলেশের হিংসা হয়। নিখিলেশ নিজের দ্বিধা কাটিয়ে সন্দীপকে নিয়ে বিমলাকে সাবধান পর্যন্ত করেনি। এখানে নিখিলেশের বাস্তববুদ্ধি সম্পর্কে কিছু সংশয় থেকেই যায়।

নিখিলেশ নির্লিপ্ত চেতনার সত্তা ৷ সন্দীপ যখন বিমলাকে নারী-পুরুষের মিলন প্রসঙ্গে বই পড়তে দেয় সেই বিষয় নিয়ে সন্দীপকে বাধা দিতে সে পারেনি। নিখিলেশ নির্লিপ্ত মানুষ। সে উন্মুক্ত হৃদয়ের মানুষ। মানুষকে নিয়ে তার ছিল আধ্যাত্মিক দৃষ্টি। মানুষকে সে দেখতে চেয়েছে অন্তরাত্মা থেকে। ফলে সন্দীপের দেওয়া নারী পুরুষের মিলন বিষয়ক গ্রন্থ বিমলাকে পড়তে দিতে সে কোন বাঁধা দেয়নি ।

নিখিলেশকে সন্দীপ একটা আইডিয়া সর্বস্ব মানুষ ভেবেছে। ঘরে যে শত্রু ঢুকেছে সে নিয়েও বিমলাকে সাবধান করেনি। নিজে সতর্ক হয়নি। সে নিজের কর্তব্য বিষয়ে সচেতন। নিজেকে প্রাধান্য দিয়ে সে পথ চলতে চেয়েছে। এটি তার অহংকার। বিমলাকে তাই বাধা দেয়নি সে। নিখিলেশ জীবনকে বাইরে থেকে দেখে যতটা ভালোবেসেছে, গভীরে ঢুকে ততটা দেখতে চায়নি। সে ট্র্যাজিডির নায়কের মতই ব্যথিত হয়েছে। একটা বোবা বেদনা তাঁকে গ্রাস করেছে। আর এই ব্যথাই তাকে তার জীবনকে হাল্কা করে হেসে উড়িয়ে দিতে প্রয়াসী করেছে। নিখিলেশ বলে- জীবনটাকে কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়ার চেয়ে হেসে উড়িয়ে দেওয়াই ভালো।বিমলাকে নিখিলেশ রেখেছে অন্তরের অন্তরতম স্থলে। বিমলাকে নিখিলেশের অনুভব—“এক দিনও ওকে ধুলোর উপর নামাইনি। ওই নামে কত পূজার ধূপ, কত সাহানার বাঁশি, কত বসন্তের বকুল, কত শরতের শেফালি। ও যদি কাগজের খেলার নৌকার মতো আজ হঠাৎ নর্দমার ঘোলা জলে ডুবে যায় তা হলে সেই সঙ্গে আমার (নিখিলেশের) কিছু করার নেই।

কবিত্ব আছে নিখিলেশের। ভাদ্রের বৃষ্টিতে জেগে উঠেছে তার ব্যথা। বিদ্যাপতির পদ স্মরণ করে সে ব্যথিত হয়েছে। সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেকেই যেন এঁকেছেন নিখিলেশের মধ্যে।


বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন