রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসের সন্দীপ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য
সন্দীপ চরিত্র
রবীন্দ্রনাথ ভণ্ডশ্রেণির জাতীয়তাবাদী নেতাদের বিদ্রূপ করতে সন্দীপ
চরিত্রকে ‘ঘরে বাইরে' উপন্যাসে এঁকেছেন। সন্দীপ লোভী। সে
স্বার্থপর। সে প্রতারক। সন্দীপ আত্মসুখসন্ধানী। তবে সমসময়ের বিপ্লবীদের মধ্যে
প্রত্যেককে সন্দীপের মতো দেখা যেত তা ঠিক নয়। দেশের মানুষ বিপ্লবীদের প্রতি ছিলেন
শ্রদ্ধাশীল। বিপ্লবীরাও সন্দীপের মতন নীচ ছিলেন না। তবে তাদের মধ্যে দু'একজন যে ভণ্ড ছিলেন না তা নয়৷
‘ঘরে বাইরে’র সন্দীপ ভালো কথা বলতে পারে। সুন্দর
ভঙ্গিতে ও কণ্ঠে চটকদারী কথায় সে পারদর্শী।বিমলাকে দেখে তার অভিব্যক্তি—“অন্ন তো রোজই একরকম জোটে, কিন্তু অন্নপূর্ণা থাকেন
আড়ালে। আজ অন্নপূর্ণা এলেন, অন্ন না হয় আড়ালেই রইল।”
এ কথায় চমক আছে।
নিজের স্থান দখলের জন্য সন্দীপ ব্যস্ত। প্রথম দেখেই বিমলাকে তার উক্তি—“আমি খাবার লোভে এখানে আসিনি। আমার লোভ কেবল আপনি ডেকেছেন বলে।”
সন্দীপ চালাক। সে বিমলাকে কথার জালে জড়ায়। তার দেশপ্রেমের মধ্যে
মিথ্যে আছে। মোহ বিস্তারে সে জানায় তার অজীর্ণ রোগ এলোপ্যাথিতে সারেনি। হোমিওপ্যাথিতে
নয়। কবিরাজি বড়ি খেয়ে সেরেছে।
লালসা আছে সন্দীপের ভেতর। নিখিলেশ বোঝে তা। সে চালাক। তার বুদ্ধি
তীক্ষ্ণ। সেই জন্য তার নীচ প্রবৃত্তির তাড়নাকে বড় নাম দিয়ে চালাবার চেষ্টা করে।
নারীই নয়, অর্থেও তার লোভ। একথা বিমলা এবং নিখিলেশের অজানা নয়।
সন্দীপ বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন। সে লোভী। তার চক্ষুলজ্জা নেই। সে নিজেকে
নিয়ে বলে— “আমরা পৃথিবীর মাংসাশী জীব। আমাদের দাঁত আছে, নখ আছে।… আমরা হয় চুরি করব, না
হয় ডাকাতি করব।”
দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে স্বদেশের কথা প্রচার করতে সন্দীপের আগ্রহ
ছিল। অথচ সন্দীপকে যে সময় নিখিলেশ রংপুরে যাবার কথা বলে, সেই সময় সন্দীপ কলকাতা ছাড়তে চাইলো না। রংপুরে গেলে বিমলার সান্নিধ্য
পাবে না। ফলে মিথ্যে যুক্তি খাড়া করতে সে দ্বিধা করে না। ঘুরে ঘুরে দেশকে মাতাবার
কাজ তার পছন্দ নয়। বিমলার ভেতর যে আগুন ও তেজ সে দেখেছে—তাতে
সে আর নিজেকে দেশনায়ক বলে গর্ব করতে চায় না। এ ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়।
সন্দীপ শুধু জানে কেড়ে নিতে। সে ভাবে আপনা থেকে যা আসে তাকে মেনে
নেওয়া অক্ষম মানুষের কাজ। কেড়ে নিয়ে যতটা আত্মসাৎ করতে পারা যায়—সেটাই
যথার্থ পাওয়া। সে বলে—“দেশে আপনা-আপনি জন্মেছি বলেই দেশ আমার
নয়, দেশকে যেদিন লুট করে নিয়ে জোর করে আমার করতে পারব সেই
দিনই দেশ আমার হবে।”
নিজের ইচ্ছেকে পূর্ণ করে সফল করতে সন্দীপের উদ্যম নেয়। নীতিবোধ তার
নেই। কেড়ে নিতে হয় বলেই পড়ে যাওয়া জিনিসের চেয়ে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া
জিনিসকে সে দামী বলে মানে।
সন্দীপের কোন লজ্জা নেই। তার শালীনতাবোধ নেই। সে ভব্যতাযুক্ত কথা বলতে
চায় না। বিমলাকে নিখিলেশের সামনেই সে বলে—“আপনি আমাদের মৌচাকের
মক্ষীরাণী।” প্রয়োজনের জিনিসকে কেড়ে নিতে পারে সন্দীপ। বা
চেয়ে নেয় দ্বিধাহীন ভাবে। দস্যুতার প্রলোভনে ভরা তার চরিত্র। সে বলে “দেওয়ালে গেঁথে যদি কেউ রত্ন আগলায়, তবে সে সিঁধ
কেটে সেই রত্ন চুরি করবে। কেউ কল করলে সে কৌশল করবে।”
যুক্তির জাল বেছাতে পটু সন্দীপ। লুকোচুরিকে কাপুরুষতা ভাবে সন্দীপ।
নিজে লুকোচুরি করে না। বলে বেড়ায় প্রয়োজন হলে সময়মতো দরকারি কাজ না করতে পারা
তার কাছে কাপুরুষতা। নিজের কাজকে সমর্থনের জন্য গুছিয়ে নিজের কথাকে যুক্তির ছলে
উপস্থিত করতে পারে সন্দীপ। সে বাকপটুতায় হার মানতে চায় না ।
সন্দীপ কবিত্বের ছোঁয়ায় কথা বলে ৷ প্রথম বিমলাকে দেখার দিনের কথা,
পরে একসময় বিমলা নিখিলেশের কাছে বর্ণনা করতে গিয়ে বলে “সেদিন
আমাদের মক্ষীরাণীকে আমি প্রথম দেখলুম—সেই জড়ির পাড় দেওয়া
কাপড় পরে চুপ করে বসে, চোখ দুটো যেন পথ হারানো তারার মতো
অসীমের দিকে তাকিয়ে, যেন কিসের সন্ধানে কার অপেক্ষায়
অতলস্পর্শের অন্ধকারের তীরে হাজার হাজার বৎসর ধরে এই রকম করে তাকিয়ে, তখন আমার
বুকের ভেতটা কেঁপে উঠল।”
মেয়েদের বশ করতে পারার ব্যাপারে কথার বাণে মেয়েদের বশ করতে পারে।
যুক্তির মতো বেজে ওঠে তার কথা। সন্দ্বীপের কথা বলার গুণে অসত্য সত্য হিসেবে ধরা
দেয়। কেউ প্রতিবাদটুকু করতে পারে না। মুগ্ধ হয় সন্দীপের প্রতি। বিমলাও এই ভাবেই
ধরা দিয়েছিল।
সন্দীপের আকর্ষণে বিমলাও স্বামীগতপ্রাণা থেকে বদলে গিয়ে সন্দীপগতপ্রাণা
হয়ে যায়। বিমলা সন্দীপের সাথে পরিচয়ের পরে নিজের সম্বন্ধে বলে—“এতদিন আমি ছিলুম গ্রামের একটি ছোটো নদী; তখন ছিল
আমার এক ছন্দ, এক ভাষা, কিন্তু কখন
একদিন কোনো খবর না দিয়ে সমুদ্রের বাণ ডেকে গেল; আমার বুক
ফুলে উঠল, আমার কূল ছাপিয়ে গেল, সমুদ্রের
ডমরুর তালে তালে আমার স্রোতের কলতান আপনি বেজে বেজে উঠতে লাগল।” এমনই আকর্ষণ সন্দীপের।
সন্দীপ বিমলাকে ভোলাতে তার স্তাবক হয়ে ওঠে। বিমলার বুদ্ধিতে সন্দীপ
পরিচালিত এবং সে কাজে বিমলা পরামর্শ দেয়নি। সে কাজে সন্দীপ ঠকে। লজ্জাহীনভাবে
এসমস্ত কথা বিমলাকে বলেছে সন্দীপ। বিমলাকে কাছে পেতে বিমলাকে মউচাকের মক্ষীরাণী
পর্যন্ত বলে সন্দীপ। বিমলার মনে এমন ধারণা সৃষ্টি করে সন্দীপ যে বিমলাকে ছাড়া
দেশের কাজ হবে না। এ তার ভণ্ডামির প্রকাশ। বিমলার কাছে কোন লজ্জা ছিল না সন্দীপের।
বিমলাকে আয়ত্তে আনতে তার মন জুগিয়ে কাব্যের মোহ বিস্তার করে।
বিমলাদের বৈঠকখানাতে সন্দীপ ইচ্ছে করেই স্ত্রী-পুরুষের মিলন বিষয়ক
একটি বই রেখে যায়। বিমলা যাতে সেটা পায়। এ পূর্ণভাবেই নীচতার পরিচয়। বিমলাকে
ধীরে ধীরে বশে আনতে পেরে সে উল্লসিত হয়।
বিমলাকে সন্দীপ বলে নারী-পুরুষের সম্পর্কে সামাজিক বা কোন বাধাই বাধা
নয়৷ দেশের স্বাধীনতা যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা।
তাই বিমলার কাছে তার কোন আড়ষ্টতা নেই। বিমলার কাছে অত্যন্ত বাস্তব, বিমলাও তার কাছে বাস্তব। মাঝে কোন কথা ছড়িয়ে মানুষের কাছে মানুষকে
দুর্গম দুর্বোধ করে তোলা সন্দীপ পছন্দ করে না।
সন্দীপ ভেবেছে ভগবান যে মন্ত্রে একটি নারী ও পুরুষের ভেতর মিলনের
মন্ত্রকে রচনা করেন মানুষ তাতে মিথ্যে যোজনা করে বিধাতার ইচ্ছেকে বাতিল করে। এই
মিথ্যের পূজারি সন্দীপ। সন্দীপ জয় করতে জানে। তা মিথ্যেয় হোক, ছল করে হোক, তার নীতি হল জেতা। জয় করতে না পারলেই
কাপুরুষ। ভ্রষ্ট চরিত্রের সন্দীপ ধীরে ধীরে নারীকে লুব্ধ করে। কথায় ভোলায়। তারপর
গ্রাস করে। বিধবা কুসুমকে সে গ্রাস করেছে। একটি ফিরিঙ্গি মেয়েকেও কব্জা করেছে।
একথা সে স্বীকার করে। তার কাছে মিথ্যেটাও সত্য।
হাটের থেকে বিলিতি সুতো বিক্রি যখন নিখিলেশ করলো না, তখন বিমলার আহত মনের সুযোগে সন্দীপ বিমলার হাত নিজের হাতে চেপে ধরে।
বিমলার অভিমানের ভেতরই সন্দীপ বিমলাকে কাছে পেতে চায়।
সন্দীপ বিমলাকে কামনার বিষয় করে তোলে। তার জন্য কোন সঙ্কোচ নেই। বিমলা
তার শিকার। বিমলাকে জব্দ করতে তার রূপের প্রশংসা করে সন্দীপ।
সন্দীপকে শুরু থেকেই ভালোচোখে দেখেননি মাস্টারমশাই চন্দ্রনাথবাবু।
সন্দীপের চরিত্রের অসারতাকে তিনি বুঝেছেন। নিখিলেশও তার চালাকিকে বুঝেছে।
বৈঠকখানায় নারী-পুরুষের মিলন বিষয়ক বইটি দেখে নিখিলেশ সন্দীপের মনোভাব সহজে বুঝে
নিয়েছে।
সন্দীপের স্বভাব আইডিয়ার প্রতি বড়াই করা। মাঝে মধ্যে নিষ্ঠুরতাও
প্রকাশ করে সে। চড়িভাতি করার দিনে বাগানে যে ছাগলটা চরছিল তার পেছনের একটা পা দা
দিয়ে কেটে আনতে সবাই ইতস্তত:। সন্দীপ অনায়াসে সে কাজ করে।
অমূল্যকে বলে বিলিতি জিনিস যে কিনছে—তাকে শাস্তি দিতে
হবে। এর বিরুদ্ধে যে মামলা করবে তার গোলায় আগুন লাগিয়ে দিতে হবে। মিরজান বিলিতি
কাপড় বেচা ছাড়বে না। সন্দীপ তার নৌকো ডুবোবার ব্যবস্থা করে।
সন্দীপ প্রবৃত্তিকে মানে। নিখিলেশ এর বিপরীত। সে নিবৃত্তির সাধক। এই
নিয়ে দুই বন্ধুর তর্কও হয়। নিখিলেশ সন্দীপকে বোঝাতে পারে না আত্মার শান্তি কী !
সন্দীপের কর্তৃত্বের মোহ ছিল। তার কথায়—“আমি পৃথিবীতে
এসেছি কর্তৃত্ব করতে। আমি লোককে চালনা করবো কথায় এবং কাজে।”
কখনো কখনো তর্কের সময় সন্দীপ নিখিলেশের মতের সঙ্গে ভান করে সমর্থন
যুগিয়েছে। এটাও একরকম কপটতা। তাকে নিজেই আবার ধিক্কার দিয়েছে। শেষের দিকে
নিখিলেশকে সে এড়িয়ে চলতে চেয়েছে।
সন্দীপ মিথ্যে সাক্ষী পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। পঞ্চুর বিক্রি করা বিলিতি
কাপড় জমিদার হরিশ কুণ্ডু সন্দীপের সামনে পোড়ায়। সন্দীপ সাক্ষী দেয় জমিদারের
পক্ষে। সবাই বিস্মিত হয়। একে সমর্থন করে সন্দীপ বলে—“যেটা ঘটেছে সেটাই বুঝি একমাত্র সত্য? যেটা ঘটা দরকার
সেটাই সত্য। সেই সত্যকে গড়ে তোলার জন্য অনেক মিথ্যে চাই।”
সত্যকে সন্দীপ মান্যতা দেবার চাইতে, সত্যকে সে বানাতে চায়।
তার লক্ষ্য ফল লাভ ৷ সত্য নয়। মিথ্যাকে জোরের সাথে বলাই তার চরিত্রের লক্ষণ।
সন্দীপ যে সময় ‘বন্দেমাতরম’-এর
মতো স্বাধীনতার ঋক্মন্ত্র উচ্চারণ করে তা যেন পবিত্রতা হারায়। সে নাকি নায়েবের
সাথে পরামর্শ করে মিরজানের নৌকো ডোবায়। ঘুষ নেবার মতো মতলব এঁটেছে। নারীর সাথে
সাথে অর্থের প্রতিও প্রলুব্ধ ছিল সন্দীপ। পঞ্চাশ হাজার টাকা যেভাবে হোক চাই।
বিমলার কাছে এটা পেতে পারে এমনটাই ভেবেছে। বিমলাকে বলে—“রাণী
অসম্ভবকে সম্ভব করতে পার তুমি। করেছো। কী যে করেছ যদি দেখাতে পারতুম তো দেখতে।
কিন্তু এখন তার সময় নয়; একদিন হয়তো সময় আসবে। এখন টাকা
চাই।”
৫০ হাজার টাকা বিমলা তার স্বামীর কাছ থেকে নিক আর বিমলার গহনাগুলো
হাতের কাছে রাখুক, কোন্ সময় কী দরকার হয়—তা বলা যায় না। নিখিলেশের টাকা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। সে টাকা
দেশের। এমনভাবেই বিমলাকে বোঝাতে চেষ্টা করে সন্দীপ। ‘বন্দেমাতরম’
মন্ত্রেই লোহার সিন্দুকের দরজা খুলবে।
বাবুয়ানি প্রিয় সন্দীপ জীবনে অন্তত একবার পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে
ওড়াতে চায় ৷ আমীর সাজতে চায়। বিমলাকে বলেছে—বাংলা মায়ের পুজো করার
ভার তার ওপর পড়েছে বটে, কিন্তু সে যে গরীব। বিমলা তখনই তাকে
জানায় যে তার বাক্স ভরা গয়না আছে। সেটা সন্দীপের জন্যই।
বিমলার আনা গিনির মোড়ক দেখে প্রথমে সন্দীপ ভাবে—বুঝি
বা এতে আধুলি রয়েছে। সন্দীপের মুখ কালো হয়ে যায়। কিন্তু যখন দেখে এতে রয়েছে
গিনি সোনা তখন মুখে ফুটে ওঠে ঔজ্জ্বল্য।
আদর করতে বিমলার কাছে এলে বিমলা তাকে ধাক্কা মারে। সরিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণ পরে মোহরগুলো নিজের রুমালে বেঁধে জানালো ছ’হাজার টাকা। সমস্ত গিনিগুলো
রুমালে ধরলো না দেখে আর একটা রুমাল চেয়ে নিল বিমলার কাছ থেকে। অমূল্যর যে সময়
সাড়ে তিন হাজার টাকার প্রয়োজনের কথা বলে আড়াই হাজার টাকা বিমলাকে ফেরৎ দিতে বলে—সন্দীপ
জানায় মেয়েরা যেমন করে দিতে পারে, তেমন কি পুরুষরা পারে।
পুরুষরা জোর শক্তি দিতে পারে।
সন্দীপের কোন নীতিবোধ নেই। নিজের কাজ হাসিল ছাড়া সে আর কিছু জানে না।
অমূল্যর মতো ছোটোদেরও কুমন্ত্রণা দেয়।
সন্দীপের সর্বস্ব ভোগপ্রবণতা। ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাসে চড়ে। রাজভোগ খায়।
আরাম প্রিয়। সন্দীপের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করুক—এটাকে
সন্দীপ সহ্য করতে পারে না । বিমলার গহনার বাক্স নিয়ে যখন অমূল্য চলে যায়,
সেই সময় সে বিমলাকে জিজ্ঞাসা করেও সদুত্তর পায় না।
শেষে বিমলার চোখেও সন্দীপের মুখোশ ছিঁড়ে যায়। বিমলা সন্দেহ করে
সন্দীপ তাকে ভোলাচ্ছে। কিন্তু তবু বিমলা ভোলে।
আবার বিমলার সংস্পর্শে এসে সন্দীপের চরিত্রে একটা পরিবর্তন এসেছিল।
বিমলার প্রতি ছিল ভোগের দৃষ্টি। সে সামাজিক বাঁধনকে মানতে চায় না। প্রবৃত্তির
চাওয়া অনুসারে সে কাজ করে। অথচ বিমলার প্রতি সন্দীপের প্রথম দিকে জন্মানো মোহ
পরিবর্তিত হতে থাকে প্রেমে। সে নারীকে ভোগ্য বস্তু বলে ভাবতো, কিন্তু বিমলা সম্পর্কে পুরোপুরি এমন ভাবনা সে ভাবতে পারেনি। বিমলা
সন্দীপকে ঠকবাজ ভেবেছে। অমূল্যর মতো ছোটো ছেলেকেও সে ভুল পথে পরিচালিত করে। আর সেই
সময় রুখে দাঁড়িয়েছে বিমলা। সন্দীপ সেই সময় বিমলার অন্য রূপে মুগ্ধ হল। বিমলাকে
না পাবার বেদনা বোধ থেকে বিমলাকে সমীহ করার মনোভাব তার দেখা দেয়। যে সন্দীপ
নিখিলেশের সামনে একদিন বলেছিল বিমলাকে—“তোমায় দেখার পর
থেকেই আমার মন্ত্র বদল হয়ে গেছে। বন্দেমাতরং নয়, বন্দে
প্রিয়ং, বন্দে মোহিনীং।” সেই সন্দীপই শেষে বলে “এবার দূরে যাবার সময় এসেছে দেবী। ভালই হয়েছে। আমার মাটির মন্দিরে তোমাকে
ধরছিল না, এ মন্দির প্রত্যেক পলকে ভাঙবে ভাঙবে করছিল;
আজ তোমার বড়ো মূর্তিকে বড়ো মন্দিরে পুজো করতে চললুম, তোমার কাছ থেকে দূরেই তোমাকে সত্য করে পাবো।”
ভোগী সন্দীপের প্রেমের বোধ তাকে কিছুটা পরিবর্তিত করেছিল। সে গহনার
বাক্স ও গিনিগুলো ফেরৎ দিয়ে যায়। বলে যায় “মক্ষীরাণী, এতদিন পর সন্দীপের নির্মল জীবনে একটা ‘কিন্তু’ এসে
ঢুকেছে।”
আসলে বিমলার কাছে আসার পরেই সন্দ্বীপের এই পরিবর্তন। এই বদলের জন্যই সে
জীবন্ত। সে Round চরিত্র। প্রকৃতিগত ভাবে সন্দীপ চরিত্রটির বদল
ঘটেছে। গিনি ও গহনা ফেরৎ তার একটা উদাহরণ। পূর্ণভাবে ভণ্ড ও কিছু সময়ের জন্য হলেও
প্রেমের সৎ দৃষ্টি ফিরে পেলেন। এই ভাবেই ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের সন্দীপকে একটি
জীবন্ত চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন