জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতার বিষয়বস্তু
‘বনলতা
সেন’ কবিতাটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বের রচনা। কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত মনে করেন,
“ধূসর পাণ্ডুলিপির আনন্দ চেতনা ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে পরিণত হয়েছে অভিজ্ঞানে। জীবন,
সৌন্দর্য, সময় চেতনা কিংবা ইতিহাস বোধ সব মিলিয়ে একটি পরিব্যাপ্ত সমগ্রতা ক্রমশই
যেন তাৎপর্যপূর্ণ অন্বেষণের পথে পাঠকচেতনাকে আকর্ষণ করে। স্পষ্টই অনুভব করা যায় ‘ধূসর
পাণ্ডুলিপি’র সীমায়িত আনন্দ, প্রেম ও সৌন্দর্যবোধের জগৎ থেকে অন্য এক ব্যাপকতর জগতে
কবির উত্তরণ, যে জগৎ আবহমান কালের ইতিহাসের অঙ্গীভূত।”
অধ্যাপক
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, জীবনানন্দের একটা নিজস্ব আঙ্গিক আছে—সেই আঙ্গিকে প্রবেশ
করা দুরূহ; বাংলা সাহিত্যে তাঁর কবিতা সবচেয়ে আত্মগত। তিনি আরও মনে করেন যে, জীবনানন্দ
প্রকৃতির কবি—সে প্রকৃতি বাংলার গ্রামের এবং অতীত পৃথিবীর। জীবনানন্দ কালকে প্রবহমান
বলে মনে করেন। তাঁর কালের কোন যতি নেই। জীবনানন্দের রোমান্টিকতা মাঝে মাঝে মিস্টিক
হয়ে উঠেছে।
কবি
সঞ্জয় ভট্টাচাৰ্য জীবনানন্দের কাব্যের ভাষাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। জীবনানন্দের
ছিল অখণ্ড সময় চেতনা। তাঁর কবিতায় ভাবাবেগ ও রোমান্টিকতা অত্যন্ত সংযত।
‘বনলতা
সেন’ কবিতাটি রোমান্টিক কল্পনায় আন্দোলিত। কবি এখানে ইতিহাস সচেতন, তাঁর সময়-চেতনাও
এখানে বিশেষভাবে পরিস্ফুট। কবির জীবনবোধের পরিচয় স্পষ্ট—
হাজার
বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল
সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক
ঘুরেছি আমি ।
অতীত-সঞ্চারী
কবি স্বভাবতই রোমান্টিক হয়ে উঠেছেন। জীবনকেও উপলব্ধি করেছেন তিনি—যে-জীবন যুগ যুগ
ধরে প্রবাহিত। কবির সময় চেতনার কোন যতি নেই, তাই হাজার হাজার বছর ধরে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন
নানা স্থানে। কবির মৃত্যুও কি নেই? অথবা মৃত্যুও জীবনের ধারার সঙ্গে জড়িত—কোন ছেদ
নয় সেটা। তিনি ঘুরেছেন ‘নিশীথের অন্ধকারে’—বহুদূরবর্তী কাল বোঝাতে কবি অন্ধকার কথাটা
ব্যবহার করেছেন। কবি নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানের সম্রাটের কথাও বলেছেন—তাতে প্রকাশ পেয়েছে
তাঁর ইতিহাস-চেতনা—
বিম্বিসার
অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে
ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে,
তুলনায়
কম দিন ‘ধূসর’ অধিক দিন ‘অন্ধকার’। চিত্রকল্পগুলো সুন্দর।
কবি
জীবনের স্বাদের সঙ্গে অবসাদকেও জেনেছেন। মানুষ ক্লান্ত হয় জীবন থেকে কোন বাধা না এলে—‘আট
বছর আগের একদিন’-এর মতো সেই অবসাদ সেই ক্লান্তি তাকে লাশকাটা ঘরেও নিয়ে যেতে পারে।
‘বনলতা সেন’ কবিতাটিতেও কবি ক্লান্ত বোধ করেছেন যথেষ্ট—
আমি
ক্লান্ত প্রাণ এক চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে
দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
প্রচণ্ড
জীবন-বোধের মধ্যেই কবি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু অঘটন কিছু ঘটেনি নাটোরের বনলতা
সেনের জন্যে। তিনি দূর করে দিয়েছিলেন কবির ক্লান্তি। হাজার হাজার বছর ধরে যিনি ছিলেন
ভ্রাম্যমাণ। তিনি সান্ত্বনা পেলেন বনলতা সেনের কাছে। কোথাকার নারী তিনি? বঙ্গদেশেরই
নাটোরের অধিবাসিনী তিনি। সিংহল-মালয়-বিদর্ভের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল নাটোর। কোন সময়ের
নাটোর? যে কোন সময়েরই হতে পারে। কালেরও যেমন ছেদ নেই, স্থানেরও নেই, স্থানেও নেই কোন
ভাষা, বিচ্ছেদ - Time space continuum, জীবনানন্দের এক বিশিষ্ট বোধ ।
কবির
সময় চেতনার বিশিষ্টতার সঙ্গে তাঁর প্রকৃতি চেতনাও মিশেছে। সিংহলের সমুদ্র মালয় সাগরের
সঙ্গে কবির মনে জেগেছে—‘সবুজ ঘাসের দেশ’—যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর তিনি
এরই সঙ্গে ‘শিশিরের শব্দের মতন’ সন্ধ্যার আগমন লক্ষ্য করেছেন। জোনাকী নদী সবই এসে দাঁড়িয়েছে
তাঁর চোখের সামনে। যুগ যুগ প্রকৃতিকে একসঙ্গে উপলব্ধি করলেন কবি। কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য
তাই বলেছেন, ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিতে কবির দু-ধারা চেতনা এসে মিশেছে – “সময়-চেতনা এবং
প্রকৃতি-চেতনা। বর্তমানের সময় গ্রন্থিতে ইতিহাসের একটা বৃত্তান্তসময় মিশিয়ে কবিতাটি
শুরু হয়েছে, শেষ হয়েছে কবির প্রকৃতি-চেতনায়। নাটোরের বনলতা সেনকে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশ’
বছরের ইতিহাসে রঞ্জিত করে দেখলেও তাকে মানবী বলে গ্রহণ করতে মুশকিল হয় না।”
কিন্তু
পাখির নীড়ের মতো চোখ পেল কোথায় বনলতা সেন? এ কি বনের লতায় পাখির নীড় যা চোখের মতো
দেখাচ্ছে? এই রোমান্টিক কল্পনা অনেকটাই মিস্টিক হয়ে উঠেছে। উপমা প্রয়োগ ও ইঙ্গিতময়
বক্তব্য সমগ্র কবিতাটিতে অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছে। যে-বনলতা সেনকে বোঝাই দুরূহ
তার চুলকে বোঝাও তো সহজ নয়—তা বিদিশার নিশারই মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন—
চুল
তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ
তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য ;
বিদিশার
নিশার অন্ধকার যার চুলে, তার মুখে শ্রাবস্তীর কারুকার্য, অদ্ভুত কল্পনা—সব মিলিয়ে
রোমান্টিক কল্পনা মিস্টিক রহস্যময়তায় পরিণত হয়েছে। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে,
জীবনানন্দের কবিকৃতির বৈশিষ্ট্যগুলোর সবকটি লক্ষণই পাওয়া যায় ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিতে।
ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও কবি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন—তাঁর কাব্যের ভাষা ইঙ্গিতময় এবং
তার ব্যঞ্জনাও সুদূরপ্রসারী।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন