ঘরে বাইরে উপন্যাসের চন্দ্রনাথবাবু চরিত্র
চন্দ্রনাথবাবুর চরিত্র:
‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে
চন্দ্রনাথবাবু ছিলেন নিখিলেশের শিক্ষক। নিখিলেশকে ভালোবাসেন তিনি। নিখিলেশের
ভালোমন্দে তিনি এই ছাত্রের পাশে থাকেন।
ঋজু প্রকৃতির মানুষ
চন্দ্রনাথবাবু। নিন্দা বা ক্ষতি অথবা মৃত্যুকে তিনি ভয় করেন না । তিনি শান্ত,
সংযত। নিখিলেশকে সত্য পথের সন্ধান দেন তিনি।
বৃদ্ধ
চন্দ্রনাথবাবুর সৌম্যদর্শন। বুদ্ধি আর বিচক্ষণতা তার প্রবল। বিমলাকে তিনি আকারে
ইঙ্গিতে সন্দীপকে নিয়ে সতর্কও করেছেন। বিমলা তাঁকে প্রণাম করলে তিনি বলেছেন—“মা ভগবান চিরদিন তোমাকে রক্ষা করুন।” নিখিলেশকে
বলেছেন নিখিলেশ যেন কিছুদিন বিমলাকে নিয়ে দার্জিলিং ঘুরে আসে।
চন্দ্রনাথবাবুর
রাজনৈতিক চেতনাও দৃঢ়। সন্দীপের সাথে বাক্যালাপে আমরা তা জানতে পারি। তার যুক্তিকে
সহজে খণ্ড করা যায় না। দেশকে নিয়ে তার চিন্তা সাবলীল। নিখিলেশের প্রতি তার মমতা
অসীম। রাতে ঘুমোতে না পেরে নিখিলেশ কষ্ট পাচ্ছে সেটাও তিনি লক্ষ্য করেছেন।
নিখিলেশের মাথায় স্নেহের হাত রেখে তাকে ঘুমোতে বলেছেন। নিখিলেশের ব্যথিত হৃদয়ে
সান্ত্বনার পরশ রেখেছেন চন্দ্রনাথবাবু। বিমলার চঞ্চল মানসিকতার মাঝে তিনি দিতে
চেয়েছেন শক্তি। বিমলা বলেছে— “মাস্টারমহাশয়ের একটা
শক্তি আছে, তিনি মনটাকে এমন একটা শিখরের ওপর দাঁড় করিয়ে
দিতে পারেন, যেখান থেকে নিজের জীবনের পরিধিটাকে এক মুহূর্তেই
বড়ো করে দেখতে পাই।” মাস্টারমশাই বিচক্ষণ। মানুষকে তিনি অত্যন্ত
ভালোবাসেন। মর্যাদা দিতে পারেন। পঞ্চু দরিদ্র। তাকে নিখিলেশ অর্থ সাহায্য করতে
চায়। মাস্টারমশাই বলেন—“তোমার দানের দ্বারা মানুষকে তুমি
নষ্ট করতে পার; দুঃখ নষ্ট করতে পার না। আমাদের বাংলাদেশে
পঞ্চু তো একলা নয়। সমস্ত দেশের স্তনে আজ দুধ শুকিয়ে এসেছে। সেই মাতার দুধ তুমি তো
অমন করে টাকা দিয়ে বাইরে থেকে জোগাতে পারবে না।”
একজন আদর্শ শিক্ষক
চন্দ্রনাথবাবু। তিনি যখন নিখিলেশের বাড়িতে পড়াতে আসতেন তখন রোদ-জল মাথায় করে
আসতেন। তিনি পছন্দ করতেন না নিখিলেশের গাড়ি তাঁকে আনতে যাক। তিনি গৌরব বোধ করতেন
নিজেকে পুরুষানুক্রমে পদাতিক বলে । তিনি বেতন ছাড়া কিছু নিতেন না। নিখিলেশ তাঁকে,
তাঁর ছেলেকে চাকরি দিতে চাইলেও তিনি অস্বীকার করেছেন। কারো কোনো
অনুগ্রহ তিনি গ্রহণ করেননি। দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন— “আমাকে
তোমাদের বড়োমানুষির ফাঁদে ফেলো না, আমি মুক্ত থাকতে চাই।”
অবশেষে তিনি থাকতে
রাজি হলেন নিখিলেশের বাড়িতে। তা অন্য কারণে নয়। নিখিলেশের প্রতি ভালোবাসার জন্য।
মাস্টারমশাইয়ের ছোটো ঘরটিতে রাত্রি ১১-১২টা অবধি নিখিলেশ গিয়ে যখন নানা কথায়
কাটাতে লাগলো, মাস্টারমশাই বুঝতেন তাঁর ছোটো ঘরে
ভাদ্রমাসের গরমে নিখিলেশের কষ্ট হচ্ছে। তিনি সেই সময়ে নিখিলেশের বাড়িতে আসতে
রাজি হয়েছেন। দয়ালু চন্দ্রনাথবাবু গরীবকেই নয়, ভালোবাসেন
বড়োলোককেও। দুঃখকে তিনি অবজ্ঞা করতে পারতেন না।
পঞ্চুর স্ত্রী মারা
গেলে যখন দারিদ্র্যের জ্বালায় পঞ্চু ছেলেমেয়েদের রেখে এক সাধুর চেলাগিরি করতে পালাল
তখন চন্দ্রনাথবাবু কাউকে কিছু না জানিয়ে পঞ্চুর অসহায় ছেলেমেয়েগুলোকে নিজের
বাসায় রেখে মানুষ করেছেন।
ফিরে আসার পরে পঞ্চুও
কিছুদিন চন্দ্রনাথবাবুর কাছে থাকে। চন্দ্রনাথবাবু অবশেষে পঞ্চুকে কিছু টাকা হ্যান্ড
নোটের মাধ্যমে ধার দিয়ে পঞ্চুকে তার নিজের বাসায় ফেরত পাঠায়। এই টাকা ধারের
বিষয়টি পঞ্চু কিন্তু ভালো চোখে নেয় না। দান গ্রহণে মানুষ অপমানিত হয় এই বোধটি
চন্দ্রনাথবাবুর ছিল। ফলে পঞ্চুর মনুষ্যত্বের প্রতি মর্যাদা দেখাতেই মাস্টারমশাই
টাকা ধার দিয়েছিলেন। পঞ্চুকে ছোটো করতে চাননি মাস্টারমশাই। বাইরে থেকে দান করে
ভেতরের দিকে ঋণী করতে তিনি চাননি।
দেশকে ভালোবাসার
ক্ষেত্রটিতেও তিনি অন্যধারার ভাবুক। দেশ মাস্টারমশাইয়ের কাছে শুধুমাত্র মাটি নয়।
তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের মানুষকে নিয়েই দেশ। দরিদ্রের ওপর কোন কিছু চাপিয়ে দিলে
তাদের পোষণ করা হয়। দিশি চিনি, অথবা দিশি নুন গরীবেরা
কিনছে না—এর অর্থ হল মানুষের সামর্থ্যে কুলচ্ছে না। দেশের
মানুষকে তার স্বাভাবিক অবস্থার প্রেক্ষিত থেকে বিচার করতেন মাস্টারমশাই।
মাস্টারমশাই কোন
সময়েই অন্যায়ের কাছে হার মানতে চাননি। পঞ্চুর হয়ে তিনি তার নকল মামীর বিরুদ্ধে
অসত্য মামলা তদারকি করার ভার নিজে নিয়েছেন। নিজে গেছেন পঞ্চুর বাড়ি তার সেই নকল
মামীর সাথে কথা বলার জন্য। শেষে সেই নকল মামী কিছু হাত খরচের টাকা চেয়ে বৃন্দাবন
যেতে চেয়েছেন।
‘ঘরে বাইরে’
উপন্যাসের চন্দ্রনাথবাবু আদর্শ মানুষ। পরাধীন ভারতে এমন মানুষের বড়
প্রয়োজন—এমন চিন্তা থেকেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথের এমন ধারার
চরিত্র সৃজনের মানসিকতার জন্ম হয়েছিল । চন্দ্রনাথবাবুর মতো শিক্ষাই পারেন জাতীয়
মেরুদণ্ডকে শক্ত করতে । জাতির ভেঙে পড়া আত্মশক্তিকে জাগাতে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন